অধ্যাপক আব্দুর রাজজাক রাজু গবেষক ও লেখক :
আপন সৌন্দর্যের অপার লীলাভূমি চিরায়ত বাংলার অপরূপ নির্মাণ শৈলীর আর বহুবিধ প্রত্ন নিদর্শনে ভরা অঞ্চল বরেন্দ্রভূমি।এই ভূমির শ্রেষ্ঠ নৃপতিদের অন্যতম পাল রাজা রামপাল। সুরপালের(১০৭৫-১০৭৭) মৃত্যুর পর তার ভ্রাতা রামপাল ১০৭৭ অব্দে বরেন্দ্রভুমির সিংহাসনে আরোহন করেন।রামপালের প্রধান রাজকীয় কর্তব্য ছিল পাল রাজ্যের হিত অঞ্চল পুনরুদ্ধার। তিনি প্রথমে মগধ,রাঢ়,ও বঙ্গের কিছু অংশে আধিপত্য বিস্তার করেন। রাজ্যের বাকি অংশ কৈবর্ত রাজ দীব্বকের দখলে রয়ে যায়।কিন্তু তার দীর্ঘ শাসনামলে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হচ্ছে পিত্তভূমি বরেন্দ্র উদ্ধার।যেভাবে পাল বংশের পতন ও দিব্বকের ক্ষমতা গ্রহণ।রামপালের ভ্রাতা দ্বিতীয় মহিপাল (১০৭০-১০৭৫)কে হত্যা করে মহিপালের সেনাপতি কৈবর্ত সামন্ত রাজ দিব্বক ১০৭৫ খ্রীঃ বরেন্দ্র অঞ্চল দখল করে রাজত্ব করতে থাকেন।রামপাল সবসময় আতঙ্কে ছিলেন যে বরেন্দ্র ভূমির অধিপতি দীব্বক সৈন্য সামন্ত নিয়ে তার রাজ্য আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু রামপাল দিব্বকে এ ধরনের সুযোগ দেন নাই।রামপাল দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে দিব্যকের ভাই রুদ্রকে পুত্র ভীম যখন বরেন্দ্র অঞ্চল অসীম দাপোটের সঙ্গে রাজত্ব করছিলেন রামপাল তখন পাল বংশের অনুগত সামন্ত রাজাদের অর্থ, ভূমি উপঢৌকন দিয়ে ভীমের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাদের সমর্থন লাভ করেন।নিভিবার পূর্বে প্রদীপ যেমন দপ করে উজ্জ্বল শিখা হয়ে জ্বলে ওঠে রামপালের রাজত্বকালে পাল রাজ্যের কৃর্তি শিখাও তেমনি শেষবারের মতো উজ্জল হয়ে জ্বলে ওঠে।রামপাল একটি বিশাল সেনাবাহিনীর গঠনের জন্য সামন্ত রাজাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকেন এবং যুদ্ধের জন্য পনের জন রাজার সমর্থন লাভ করেন। এদের মধ্যে নওগাঁ জেলার মান্দা থানার কুসুম্বার রাজা বা কৌসম্বীপতি দ্বোপবর্ধন ও পাবনার রাজা বা পদুমবার রাজা সোম অন্যতম। (সন্ধ্যাকর নন্দী রামচরিতম)।
ভিম ও রামপালের মধ্যে সাক্ষাৎ যুদ্ধ হয়। ভীমের সেনাপতি হরিহর বাবু ভীমের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন।ভীম যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হন।এর ফলে কৈবর্ত রাজের সেনাবাহিনীর সত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ভীম তার স্ত্রীর শঙ্খমালা ও পরিবারবর্গ কে উন্মুক্ত বদ্ধ ভূমিতে হত্যা করা হয়।পিতৃভূমি উদ্ধারের পর রাজা রামপাল পালরাজ্যে তার সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। কৃষি উন্নয়ন, রাস্তা ঘাট নির্মাণ,নতুন নগর পত্তন, প্রজাদের পানীয়জলের ব্যবস্হা করন সহ প্রজাদের মঙ্গলের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।এরপর তিনি নতুন রাজধানী রামাবতী স্থাপন করেন। রামপাল তার রাজ্যে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার পর “রামাবতী” নামে একটি নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। সন্ধ্যাকর নন্দীর মতে রামাবতী গঙ্গা ও করতোয়া নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত ছিল।(সন্ধ্যাকর নন্দী, রাম চরিতম) আইন ই আকবরীতে রামামতিকে বসৌতি রুপ বলা হয়েছে।গ্রন্থকারের মতে ষোড়স শতাব্দী পর্যন্ত রামাবতি নামে একটি প্রাচীন জনপদ ছিল।
(আবুল ফজল,আইন ই আকবরী) জগদল মহাবিহার স্থাপনঃ রাজা রামপাল গৌড় রাজ্য উদ্ধারের পর রামাবতী নামে নতুন রাজধানী স্থাপন করেন। এই রামাবতী নগরের মধ্যখানে রাজা রামপাল জগদ্দল মহাবিয়ার স্থাপন করেন। (ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন বাংলার ইতিহাস)বিহারের অবস্থানঃ
কোন কোন ঐতিহাসিক জগদ্দল মহাবিহার দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত বলে উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গত জগদ্দল মহাবিয়ার ধামইরহাট উপজেলা থেকে ৮ কিলোমিটার পূর্ব-উত্তরে অবস্থিত।আর এই ধামইরহাট উপজেলা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দিনাজপুর (আসন,দিনাজপুরে-২ বালুর ঘাট,ধামইরহাট) জেলার অধীনে ছিল।(ঐতিহাসিক রাম প্রাণ গুপ্ত)
বৌদ্ধ মন্দির স্হাপনঃ একাদশ বা দ্বাদশ শতাব্দীতে রাজা রামপাল বৌদ্ধ বিহার সহ বৌদ্ধ দেবতা আলোকিতেশ্বর ও দেবী মহাতারার নামে বিহার প্রাঙ্গণে এই মন্দিরটি স্থাপন করেন। (নীহাররঞ্জন রায়, বাঙালির ইতিহাস)।জগদ্দল মহাবিহারে সাহিত্য চর্চা রাজা রামপাল নির্মিত জগদ্দল মহাবিহার টি প্রাচীন বাংলার শিক্ষা- দীক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। এই বিহারে দুজন স্বনামধন্য পন্ডিত হলেন সাতখানা গ্রন্থের তিব্বতি অনুবাদক আচার্য দানশীল ও রাজপুত্র গ্রন্থাকার ও টিকাকার বিভূতি চন্দ্রসহ অনেকে।
বর্ণনায় সুভাষ মুখোপাধ্যায়, বাংলার ইতিহাস।জগদ্দল বিহার খনন। ১৯৯৬ সালের পর বিহাটিতে তিনবার খননের কাজ হয় উৎখননের পর এখানে যে ধ্বংসস্তূপ পড়ে আছে তার আয়তন পূর্ব-পশ্চিম ১০৫ মিটার /৮৫ মিটার দেওয়াল প্রায় ৫ মিটার৫ মিটার। (কাজী মো মিছের,রাজশাহীর ইতিহাস) রামাবতী পাল রাজবংশের শেষ রাজধানী। সাহিত্য ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠ পোষক রাজা রামপাল একাদশ শতাব্দীতে এই বিহারটি নির্মাণ করেন। এবং এখান থেকে বিক্রমশিলা বিহার, পূর্বপুরুষের নির্মিত পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার, অগ্রপুরী বিহার, ও হলুদ বিহার দেখাশোনা করতেন বলে ঐতিহাসীকদের ধারণা।