নিজস্ব প্রতিবেদক
সিলেট বিভাগের নিম্ন আয়ের লোকজনের চিকিৎসার সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠিত ৩০০ শয্যা নিয়ে যাত্রা শুরু হয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের। জন সাধারনের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারনে ১৯৭৮ সালে ৫০০ বেড এবং ১৯৯৮ সালে হাসপাতালের বেড সংখ্যা ৯০০ তে উন্নীত করা হয়। বেডের সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি মানব সেবা! কালক্রমে হাসপাতল হয়ে উঠেছে রোগিদের জন্য আতঙ্কের নাম।
জানা যায়, এই হাসপাতালে ৪৫০ চিকিৎসক ও প্রায় ১১শর উপরে নার্স নিয়ে ৩৬ টি বিভাগে চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে।সরকারি হাসপাতাল হলেও এখানে বেসরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেশী টাকা গুনতে হয়। জরুরী বিভাগের টিকেট থেকে শুরু করে অপারেশন পর্যন্ত ধাপে ধাপে দিতে হয় টাকা। টাকা ছাড়া কোন কাজই হয়না। তাইতো নামে সরকারি হাসপাতাল হলেও টাকা ছাড়া রোগীরা অসহায় হয়ে পড়েন
সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জেলা উপজেলা থেকে রোগীরা ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসেন স্বল্প খরচে চিকিৎসা নিতে। কিন্তু হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তাদের সেই ধারনা পাল্টে যায়। তার কারন হিসেবে জানা যায়, এই হাসপাতালে সরকারিভাবে দেয়া সব কিছুতেই চলে টাকার খেলা।
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম ধাপ হল রোগী ভর্তি করা। যেখানে অন্যান্য দেশের নিয়ম হল আগে রোগী ভর্তি পরে হাসপাতালের নিয়ম কানুন পুরণ করা সেখানে সিলেট ওসমানী হাসপাতালে জরুরী বিভাগে রোগী নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে আগে টিকেট নিতে হবে।
তা না হলে রোগী ভর্তি করা হবে না। টিকেট নিতে গেলে শুরু হবে প্রশ্ন রোগী ভর্তি করবেন না বহির্বিভাগে দেখাবেন?
বিভিন্ন সুত্র থেকে জানা যায়, যদি রোগী ভর্তি করতে হয় সেক্ষেত্রে আপনি দিতে হবে ২০ টাকা অথচ টিকেটের মুল্য ১০ টাকা লিখা রয়েছে। টিকেট নেওয়ার পর রোগীকে হুইল চেয়ারে করে ওয়ার্ডে নিয়ে গেলে ১০০-১৫০ টাকা, আর রোগীর অবস্থা খারাপ হলে ট্রলি দিয়ে নিতে গেলে গুনতে হব ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। ওয়ার্ড পর্যন্ত গিয়ে কিন্তু ভাগান্তি শেষ নয়।ওয়ার্ডে নিয়ে যাওয়ার পর রোগীর সাথে ১জনের বেশি প্রবেশ করলে জন প্রতি ২০-৫০ টাকা, বেড নিলে দিতে হবে ১০০ টাকা না হয় ফ্লোরে রোগীকে নিয়ে থাকতে হবে। রোগী ভর্তি শেষ। এবার ডাক্তারের পালা। ডাক্তার আসবেন রোগী দেখবেন তারপর শুরু হবে সেই কাঙ্কিত পরিক্ষা।প্রথমে কমপক্ষে ৫-৬ টি পরিক্ষার সাথে ১বস্তা স্যালাইন ও কিছু ঔষধ। পরিক্ষার রিপোর্ট আসা পর্যন্ত স্যালাইন আর ঔষধ চলবে।
এখনেই শেষ নয়, রিপোর্ট আসার পর আসবেন বড় ডাক্তার উনি দেখে আবার অন্য পরিক্ষা দিবেন। সেটার রিপোর্ট আসার পর আপনার ভাগ্যে ঝুটবে চিকিৎসা। সেই সাথে বিভিন্ন কোম্পানীর ঔষধ তো আছেই। সেসব কোম্পানীর ঔষধ লিখার মাঝেও রয়েছে পার্সেন্টিস।্এভাবে ১/২ দিন পর পর ডাক্তার আর রিপোর্ট পরিবর্তন করতে করতে আপনার পকেট যখন শুন্যের কোঠায় তখন আপনি টাকার জন্য অন্যর কাছে হাত পাতা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।
অপরদিকে পরিক্ষার জন্য যতবার হুইল চেয়ারে বা ট্রলিতে যাবেন ততবার গুনতে হবে টাকা। ১০০-১৫০ টাকা না দিলে আপনাকে রোগী নিয়ে হেটে যেতে হবে।সেই সাথে রোগীর সাথে দেখা করতে আসলে দারোয়ানকে খুশি করতে হবে। না হয় হাসপাতালের নিয়মের কাছে আপনি অসহায়।
আপনার রোগীর অপারেশনের প্রয়োজন হলে আপনাকে অগ্রীম ৬০০০ থেকে ৭০০০ টাকার ঔষধ কিনে ডাক্তারের হাতে দিতে হবে। যাহা অফেরতযোগ্য, কিন্তু উনাদের কাছে ফেরতযোগ্য! অপারেশনের পর সে ঔষধগুলো চলে যায় ফের ফার্মেসীতে। আর ঔষধের মুল্য চলে আসে ডাক্তার বাবুদের কাছে।
অপারেশন যদি ভালভাবে সম্পন্ন হয় তাহলে অপারেশন থিয়েটারের বয়কে খুশি করতে হবে। দারোয়ানকে খুশি করতে হবে। এবং প্রতিদিন ড্রেসিং করার জন্য ও খাওয়ার জন্য ঔষধ কিনতে হবে।
রোগী সুস্হ্য, এবার রিলিজ দেওয়ার পালা।সেখানেও আছে টাকার খেলা, নার্সকে খুশি, দারোয়ানকে খুশি, ওয়ার্ড বয়কে খুশি মানে সবাইকে খুশি করে লেংটা হয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আর যদি অপারেশনে রোগী মারা যায় তাহলে টাকা এবং মানুষ সব শেষ। তখন সেই গান গেয়ে গেয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করতে হবে:- টাকা হল সব মাটি, হাতে এখন ভিক্ষার বাটি।
ওসমানী হাসপাতালের উপর এত অভিযোগ থাকার পরও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থাকেন নীরব। গত ৫ আগষ্টের পর সিলেট বাসীর মনে আশার সঞ্চার হয়েছিল হয়ত এখন অসহায় গরীব রোগীরা ভাল চিকিৎসা ও সুযোগ সুবিদা পাবে।
কিন্তু কথায় আছে কুকুরের লেজ কখনও সোজা হয়। তেমনি দালাল কখনও ভাল হয়না। বরং ইদানিং সিলেট ওসমানী হাসপাতালে পুর্বের চেয়ে দ্বিগুন অপরাধ বেড়েছে।
হাসপাতে খালি বেড পড়ে রয়েছে। অথচ রোগীরা নিচে।নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুনামগঞ্জের এক রোগীর ভাই জানান, তিনি ৩ দিন যাবৎ হাসপাতালের৷ ফ্লোরে রোগী নিয়ে শুয়ে আছেন। কোন বেড দেয়া হয়না।ওয়ার্ড বয়কে টাকা দিলে সে বেড দিবে বলে জানায়। অথচ খালি বেড পড়ে রয়েছে। তিনি বলেন, টাকা না দেয়ায় আমার রোগী ফ্লোরে পড়ে রয়েছে।বিশ্বনাথের কামরুজ্জামান জানান, তিনিও আজ কয়েকদিন হল রোগী নিয়ে হাসপাতালে আছেন। ৩০০ টাকার বিনিময়ে বেড পেয়েছেন তাও ২ দিন রোগী নিয়ে ফ্লোরে থাকার পর।
ওসমানীনগরের খাদিজা বেগম এসেছেন তার মেয়েকে নিয়ে, তিনি বলেন, আমার মেয়েকে ওয়ার্ড পর্যন্ত নিয়ে আসতে খরচ হয়েছে ৩৫০ টাকা। এখন বেড নাই। বেড নিতে গেলে নাকি দিতে হবে ২০০ টাকা।সিলেট শহরতলীর খদিম নগর এলাকার সফিক মিয়া তার শশুরকে নিয়ে এসেছেন ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য।
তিনি বলেন, টিকেট থেকে শুরু করে অপারেশন পর্যন্ত ওদের টাকা দিতে হয়। এখানে টাকা হলে সব পাবেন নতুবা কষ্ট করবেন।
হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড ঘুরে দেখা গেছে শুধু টাকার খেলা। এব্যাপারে কয়েকজন ওয়ার্ডবয় ও আায়ার সাথে কথা বলতে চাইলে সাংবাদিক পরিচয় জেনে সটকে পড়েন।
তবে সাহসী কয়েকজন ওয়ার্ড বয় বলেন, এসব সংবাদ প্রকাশ করে লাভ নেই। আমাদের বিরুদ্ধে কেউ কোন পদক্ষেপ নিবেনা।তার কারন জানতে চাইলে জানা যায়, এদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে এরা কর্মবিরতির ডাক দিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে নাজেহাল করে ফেলে।
ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ তুললে হয় এরা রোগীর চিকিৎসায় অবহেলা করে নতুবা আন্দোলন করে পরিস্হিতি ঘোলাটে করে ফেলে।মোট কথা তাদের কাছে সবাই জিম্মি।
এ ব্যাপারে ভুক্তভোগীদের দাবী, সঠিক তদন্ত করে এসব কাজের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে।