গাজীপুর প্রতিনিধি:
গাজীপুরে শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে ভুয়া ডিগ্রিধারী ডাক্তার। খুলেছেন ফার্মেসি, দন্ত চিকিৎসা কেন্দ্র, ডায়াগনস্টিক সেন্টার। বিভিন্ন উপায়ে অবাধে চালাচ্ছেন চিকিৎসা বাণিজ্য। এসব হাতুড়ে ডাক্তারের ভূতুড়ে চিকিৎসায় বিপাকে পড়েছেন এলাকার সাধারণ মানুষ। ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন শত শত সাধারণ মানুষ। রোগীর স্বজনদের অভিযোগ, এসব অপচিকিৎসার বিষয়ে স্থানীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানানো হলেও রহস্যজনক কারণে ভুয়া ডাক্তারদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ।
তথ্য বলছে, কমপক্ষে এমবিবিএস বা বিডিএস ডিগ্রি প্রাপ্তরা ছাড়া কেউ নামের আগে ডাক্তার পদবি লিখতে পারবেন না। অথচ অনেকেই তাদের প্রেসক্রিপশন প্যাডে নামের আগে “ডাক্তার” ডিগ্রী লাগিয়ে রোগীদের জটিল কঠিন রোগের চিকিৎসা দিয়ে যাচ্ছেন। দেশজুড়ে ভুয়া ডিগ্রিধারী ডাক্তারের দৌরাত্ম্য এখন আশঙ্কাজনক পর্যায়ে। বিভিন্ন বাহারি ডিগ্রি সংবলিত সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নিরীহ রোগীদের প্রতারিত করছেন তারা। ফলে চিকিৎসাসেবায় চরম অরাজকতা বিরাজ করছে। ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে রোগীদের জীবন। গাজীপুরের প্রতিটি উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে হাট-বাজারগুলোতেও অবাধে চলছে এ বাণিজ্য।
সরেজমিনে দেখা যায়, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন এর বিভিন্ন ওয়ার্ড, জেলার সকল উপজেলা, ইউনিয়নসহ বিভিন্ন স্থানের হাটে-বাজারে এসব ডাক্তার ও দন্ত চিকিৎসকদের ছড়াছড়ি। সামান্য সমস্যা নিয়ে তাদের কাছে গেলেই গুনতে হয় হাজার টাকা। সমস্যা নিয়ে গেলে বেড়ে যায় সমস্যা। দিনের পর দিন অবাধে তারা প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চালাচ্ছেন এসব কর্মকাণ্ড। ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে খুলেছেন এসব চিকিৎসা কেন্দ্র। তাদের কাছে নেই শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র, নেই প্রশিক্ষণ, নেই কোনো কাগজপত্র।
ফার্মাসিস্ট ছাড়া, ডাক্তারি লেখাপড়া ছাড়া এবং ড্রাগ লাইসেন্স ছাড়া কিভাবে তারা চালাচ্ছেন এসব ব্যবসা? এমন প্রশ্নের জবাবে কয়েকজন বলেন, এ গ্রাম এলাকায় কে এসব দেখতে আসবে? আমরা ঔষধ দেই খেয়ে ভালো না হলে উপজেলা বা জেলা হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই। যে ভালো হয়, সেতো হয় ই। আমরা ব্যবসা করছি, চুরিতো আর করছি না।
স্থানীয় সচেতন নাগরিকরা বলছেন, মানুষ অসুস্থ হয়ে এসব ডাক্তারের কাছে গিয়ে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। সাধারণ মানুষ তো আর বুঝবে না কে বড় ডাক্তার। তারা সবসময় প্রতারণার শিকার হচ্ছে। যারা এসব দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন তাদের উচিত একদম গ্রাম পর্যায়ে অভিযান চালানোর এবং গ্রামীণ পর্যায়ে সঠিক স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা। ভুয়া ডিগ্রী ব্যবহারকারী চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে দেশে কার্যকর অভিযান নেই বললেই চলে।
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সতর্কবার্তা দিয়েই দায়িত্ব শেষ বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি)। র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়নসহ কয়েকটি সংস্থার অভিযান কার্যক্রমও চলে সীমিত পরিসরে। তাদের পক্ষেও অলিগলিতে বসে থাকা ভুয়া ডিগ্রী ব্যবহারকারী চিকিৎসকের দশভাগের একভাগের কাছেও পৌঁছা সম্ভব হয়ে ওঠে না। স্বীকৃত প্রোস্ট গ্র্যাজুয়েশন ডিগ্রী না থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসকদের কেউ কেউ নিজেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হিসেবে পরিচয় দিয়ে যাচ্ছেন যা বিএমডিসি আইনের পরিপন্থী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সাইনবোর্ড, প্রেসক্রিপশন প্যাড, ভিজিটিং কার্ড ইত্যাদিতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক লেখা দেখে চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রত্যাশিত চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এ এলাকার রোগীরা। শুধু তাই নয়, আইন অমান্য করে কোন কোন চিকিৎসক তাদের ব্যবস্থাপত্রে এমন কিছু ওষুধ লিখছেন, যা সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ। অবাধে খুলেছেন দন্ত চিকিৎসা কেন্দ্রও। এতে একদিতে যেমন দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা হয়ে পড়ছে প্রশ্নবিদ্ধ, অন্যদিকে ভুল চিকিৎসার শিকার হয়ে রোগীরা অকালে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক বলেন, স্বাস্থ্য সেক্টরে দুর্বল মনিটরিংয়ের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দায়ী। কেউ কারো দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করেন না। দেশে ভুয়া ডিগ্রীধারী ডাক্তারের অভাব নেই। তাদের কারণে আমাদের বদনাম হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে যদি নিয়মিত একেকটি গ্রামের হাট-বাজারে অভিযান চালানো যেতও তাহলে এসব ভূয়া ডাক্তারের দৌরাত্ম্য কমে যেতও। তারা কেনও করেন না এ বিষয়ে আমরা কিছু বলতে পারি না।
এসব বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও জেলার সিভিল সার্জন কর্মকর্তাকে পাওয়া যায়নি। তবে জেলার কয়েকজন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে কথা হলে তারা জানান, আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করি। আমরা এসবের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছি।