সিলেটের জৈন্তাপুরে চোরাচালানের রাজত্ব: পুলিশের তিন সদস্যের বিরুদ্ধে বখরা তোলার অভিযোগ
বিশেষ প্রতিবেদক:: সিলেটের জৈন্তাপুর সীমান্তে চোরাচালানি চক্র নতুন কৌশলে সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এই চোরাচালান চক্রের সাথে সরাসরি জড়িত থানার দুই এসআই, এক কনেষ্টবল। যদিও কনেষ্টবল নিজেকে পরিচয় দেন তিনি থানার ওসির ক্যাশিয়ার হিসাবে। যদিও গত ১৯ নভেম্বর সুরাইঘাট, জৈন্তাপুর ও লালাখাল বিওপির টহলদল সীমান্তে পৃথক অভিযান চালিয়ে মালিক বিহীন অবস্থায় ৩ হাজার ৬০ কেজি ভারতীয় পেঁয়াজ, ১২০ কেজি জিরা, ২টি গরু, ২টি ইঞ্জিনচালিত কাঠের নৌকা এবং ২টি পিকআপ জব্দ করেছে। এই মালামালের সিজার মূল্য ছিল ৩৯ লাখ ৩৭ হাজার ২০০ টাকা। কিন্তু কোন চোরাকারবারিদের আটক করতে পারেনি। জৈন্তাপুর থানার প্রায় শতাধিক পয়েন্টে দিয়ে দেশে প্রবেশ করে ভারতীয় চোরাচালানের পন্য আর এসব পন্য থেকে পুলিশের লাইনের টাকা হিসাবে বখরা আদায় করেন, থানার এসআই ওবায়দুল ইসলাম, এস আই রাজন দেব ও কনেষ্টবদল সৈয়দ আবেদ আলী। চোরাকারবারিদের সাথে মিটিং করে ওসির নির্দেশে নাকি এই তিন পুলিশ সদস্য ভাগ করে নিয়েছেন। ভারতীয় চোরাচালানের কোন খাতের টাকা কে উত্তোলন করবেন। সরেজমিনে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, এলাকার কোনো কোনো ব্যবসায়ী, জনপ্রতিনিধি দ্রুত ‘বড়লোক’ হওয়ার স্বপ্নে বিনিয়োগ করছেন এসব চোরাচালানসহ মাদকের কারবারে। তাদের বিনিয়োগে সীমান্তের ওপার থেকে প্রতিদিন আসছে, গরু, মহিষ, মোবাইল কসমেটিক, কিট, চাপাতা, জিরা, কাপড় সহ নানা ধরনের মাদক, প্রকাশ্যে এসব ব্যবসা চললেও স্থানীয় প্রশাসন নির্বিকার রয়েছে।
জৈন্তাপুর সীমান্তের শতাধিক পয়েন্ট দিয়ে ভারত থেকে অবৈধপথে বাংলাদেশে চোরাচালানে ‘একক নিয়ন্ত্রণ’ করেন আব্দুলসহ তার বাহিনী। সীমান্ত ঘেঁষা চোরাচালান সংশ্লিষ্ট কয়েকজন বলেন, বর্তমানে গরু মহিষ আনার লাইনে আব্দুল নামের ঐ ব্যক্তির হাতে একক নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। আব্দুল চক্রের মালামাল রাতের অন্ধকারে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে নিরাপদে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। চোরাচালান মরিছমারা, ঘিলাতৈল, ফুলবাড়ী, গৌরীশংকর, টিপরাখলা, করিমটিলা, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একটি অংশ এবং সীমান্তবর্তী জনগণ অভিযোগে করে বলেন, থানার এসআই ওবায়দুল ইসলাম, ভারতীয় গরু মহিষ চোরাচালানীদের সাথে জড়িত। তিনি জৈন্তাপুর উপজেলার সব কয়টি পয়েন্টে দিয়ে আসা গরু মহিষের বখরার টাকা তুলে থাকেন। প্রতিটি গরু থেকে দুই হাজার ও মহিষ থেকে তিন হাজার টাকা আদায় করেন তিনি। ভারতীয় কসমেটিকস, চোরাই মোটরসাইকেল (হোন্ডা) ও কিট, জিরার, মাদকের টাকা তুলেন এসআই রাজন দেব।
প্রবেশ করছে চোরাই পণ্য। বিশেষ করে উপজেলার নলজুরী খাসিনদী, খাসি,হাওর, মোকামবাড়ী, আলুবাগান, মোকামপুঞ্জি, শ্রীপুর, আদর্শগ্রাম, মিনাটিলা,কেন্দ্রী মন্দির, কাঁঠালবাড়ী, কেন্দ্রী হাওর, ডিবির হাওর, (আসামপাড়া), কমলাবাড়ী, ভিতরগোল, গোয়াবাড়ী, বাইরাখেল, হর্নি, ময়না, নয়াগ্রাম, জালিয়াখলা, কালিঞ্জি, লালমিয়া ও অভিনাশের টিলা, জঙ্গিবিল, আফিফানগর, তুমইর, বাঘছড়া, বলিদাঁড়া, রাবারবাগান, ইয়াংরাজা এলাকা অন্যতম। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি চোরাচালান বাংলাদেশে প্রবেশ করছে ৪৮ বিজিবির ডিবির হাওর, ১৯ বিজিবির ঘিলাতৈল, ফুলবাড়ী, গৌরীশংকর, টিপরাখলা, করিমটিলা, ভিতরগোল, গোয়াবাড়ী ও বাইরাখেল সীমান্ত দিয়ে। এরমধ্যে রয়েছে, চা-পাতা, কসমেট্রিকস, শাড়ি, লেহেঙ্গা, ভারতীয় মোটরসাইকেল, আমদানি নিষিদ্ধ শেখ নাছির উদ্দিন বিড়ি, চেতনানাশক ওষুধসহ বিভিন্ন ধরনের ওষুধ, হরলিক্স, শিশুখাদ্য, বিস্কুট, চকোলেট, ভারতীয় টাটা গাড়ির টায়ার, টিউবসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ। মাদকের মধ্যে রয়েছে ভারতীয় ব্র্যান্ডের সিগনেচার, ওল্ডমং, ম্যাজিক মোমেন্ট, নাম্বার ওয়ান, ব্লেন্ডার প্রাইড অফিসার্স চয়েস, রামানভ মাদক। এছাড়া ফেনসিডিল, ইয়াবা, গাজা ইত্যাদি।স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনা সরকারের পতনের পর চার-পাঁচ দিন বন্ধ থাকলেও ফের নতুন করে শুরু হয় চোরাচালান। বিজিবির লাইনম্যান পরিচয়ে প্রতিটি ভারতীয় মালামাল থেকে নিচ্ছেন মোটা অংকের টাকা। তাছাড়া পুলিশ ল্যাইনের নামেও তুলা হচ্ছে মোটা অংকের টাকা। স্থানীয় বাসিন্দা ও চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকরা জানান, জৈন্তাপুর উপজেলার নিজপাট ও জৈন্তাপুর ইউনিয়নের সীমান্তের পয়েন্টগুলোর যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ সুবিধাজনক। ফলে সীমান্ত থেকে সহজে পণ্য পরিবহন করা যায়। এছাড়া ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় চোরাকারবারিদের কাছে বেশ পছন্দের পয়েন্ট এই গুলো। গরু-মহিষ এই দুই ইউনিয়নের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করাতে বেগ পেতে হয় না। ফলে এই পথ ব্যবহার করে পশু দ্রুত স্থানীয় বাজার গুলোয় নিয়ে যাওয়া যায়। পরে ইজারার ফি দিয়ে গরু-মহিষ বিক্রির রশিদ নিয়ে ট্রাকে করে দেশের বিভিন্ন হাট-বাজারে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। অবশ্য এর জন্য সোর্স ও লাইনম্যানদের মোটা অঙ্কের টাকা দিতে হয়। স্থানীয়দের দাবি, এসব চারাচালানকারীদের সাথে পুলিশের কিছু সদস্য সরাসরি জড়িত রয়েছেন। সম্প্রতি সময়ে জৈন্তাপুরে
একাধিক চোরাকারবারি জানান, এসআই রাজন দেবের লাইন ছাড়া কোনো মালামাল জৈন্তাপুর সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেনা। সীমান্ত দিয়ে আসা বিভিন্ন চোরাই পণ্য হরিপুর এলাকায় মজুদ, নিরাপদ প্রবেশ ও টাকার হিসাব তোলার দায়িত্বে রয়েছেন কনস্টেবল সৈয়দ আবেদ আলী। তিনি নাকি জৈন্তাপুর থানার ওসির ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি সূত্র জানায়, আগামী সপ্তাহে বড় আকারের একটি চোরাচালানের বহর জৈন্তাপুর সীমান্ত দিয়ে দেশে প্রবেশ করবে। আর এই মালামালগুলো আসবে লাইনম্যান আব্দুল চক্রের মাধ্যমে। তিনি থানার ওসির নিয়োগকৃত লাইনম্যান।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই ওবায়দুল ইসলাম বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছুই জানি না, বলেই ফোনের লাইন কেটে দেন। আর এসআই রাজন দেব বলেন এর আগেও আমাকে দুজন ফোন দিয়েছিলেন। এখন আপনিও দিলেন। কিন্তু আমি এসব বিষয়ে কিছুই জানিনা। তবে কনস্টেবল সৈয়দ আবেদ ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। এ ব্যাপারে জানতে চোরাকারবারী আব্দুলের সাথে যোগোযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সীমান্তের চোরাচালান বিষয়ে জানতে জৈন্তাপুর থানার ওসির সাথে যোগাযোগ করা হলে, তিনি বলেন, চোরাচালান আমাদের এখানে আছে আর আমি চোরাচালান প্রতিরোধে ব্যস্ত আছি। এদিকে চোরকারবারীদের কাছ থেকে পুলিশের দুই সদস্যের টাকা উত্তোলনের বিষয়ে ওসি বলেন, এই বিষয়টি আমার জানা নেই, আমি যাচাই করছি।
সূত্র-দৈনিক চিত্র