স্বর্নজিত দেবনাথ:
সিলেটে জুয়েলারী পাড়ায় প্রতারণার শিকার হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতাগণ; দেখার জন্য কেউ নেই। ‘পাথরে ভাগ্য ফিরে’ প্রবাদ প্রতীম এই বাক্যে বিশ্বাসী হয়ে সারা বিশ্বের অসংখ্য মানুষ পাথর ধারণ করেন। কিন্তু সিলেটের জুয়েলারী পাড়ায় আধিপত্য বিস্তার করে থাকা পাথর ক্রেতার নয়, ব্যবসায়ীর ভাগ্যই ফেরাচ্ছে। অন্তত আমাদের অনুসন্ধানে দেখা যায় সিলেটের জুয়েলারী পাড়ার চিহ্নিত অষ্টরত্ন’র নিয়ন্ত্রনাধীন কতিপয় মুষ্টিমেয় আইসি
গোল্ড ও রুপার নামে অ্যালুমোনিয়ামের অলংকার ব্যবসায়ীদের জুয়েলারী পাড়ার প্রতারণা। এই সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের প্রতারণার আরেক উপকরণ হচ্ছে পাথর। বিভিন্ন জনের কাছে যা ‘মনিরত্ন’ হিসেবে স্বীকৃত।
সিলেটের জুয়েলারী পাড়ার ৩ শতাধিক জুয়েলার্সের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে ২ লক্ষ টাকার পাথর কেনা—বেচা হয়। এই মোটা অংকের টাকার পাথরের মধ্যে মাত্র ৫ শতাংশ পাথর আসল আর বাকি ৯৫ শতাংশ পাথরই কৃত্রিম, বিকল্প বা নকল। এই নকল সর্বস্ব পাথরের কাছে প্রতিদিন মার খাচ্ছে ক্রেতার আস্থা এবং প্রতারিত হওয়ার পাশাপাশি প্রতিদিন ক্রেতাকে মোটা অংকের আর্থিক গচ্ছা দিতে হচ্ছে। জুয়েলারী ব্যবসায়ীরা ১৫ থেকে ৫০ টাকায় কেনা পাথর বিক্রি করছে ১ থেকে ৫ হাজার টাকায়। এই পাথরের মান নিরীক্ষনের জন্য সিলেটে কোন ক্যামিক্যাল ল্যাবরেটরি নেই। তবে ডায়মন্ডের গুণগত মান নির্ণয়ের জন্য গোটা সিলেটে মাত্র ৭ থেকে ৮টি ‘চেকিং ইনডিকেটর রয়েছে। এই মেশিনগুলো ব্যবসায়ীদের স্বার্থে ব্যবহৃত হলেও ক্রেতা জানতেই পারছে না মান নির্ণয়ের জন্য এমন কোন যন্ত্র সংশ্লিষ্ট জুয়েলার্সে রয়েছে।
পাথর ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পরিমাপক পদ্ধতি ‘ক্যারেট’ হওয়ার কথা থাকলেও সিলেটের বাজারে পাথর বিক্রি হচ্ছে ‘রতি’ হিসেবে। স্ট্যান্ডার্ড পরিমাপক পদ্ধতিতে অর্থাৎ গ্রাম পদ্ধতিতে পাথরের ওজন জানেন না অনেক ব্যবসায়ী। ২ পয়েন্ট সমান ১ ক্যারেট বা ১ ক্যারেট সমান দেড় রতি-এ হিসেব না জানলেও ৯৬ রতিতে ১ ভরি-এ হিসেবে তারা বেশ বিজ্ঞ। প্রায় ১শ’ জাতের পাথরের মধ্যে সিলেটের বাজারে প্রচলিত রয়েছে ডায়মন্ড আকিক, পান্না, রুবী বা চুনি, নীলা, পোখরাজ, প্রবাল, ফিরোজা, ক্যাটসআই, মুক্তা, মুনস্টোন, টাইগার, গার্নেড, ওপেল, জমরুদ, মরিয়ম, গোমেদ ও এডি। মানের প্রকার ভেদে এই পাথরগুলোর রয়েছে বিভিন্ন নাম। ডায়মন্ড, বেলজিয়াম ডায়মন্ড, ব্ল্যাক ডায়মন্ড, ইয়েলো ডায়মন্ড, এডি বা আমেরিকান ডায়মন্ড, পান্না, ছোঁয়াত পান্না, রুবী, চুনিরুবী, বার্মিজ রুবী, নীলা, পদ্ম নীলা, ইন্দ্রনীলা, এ্যামিতিশ নীলা, পোখরাজ, টুপাজ, প্রবাল, শ্বেত প্রবাল, গে․রী প্রবাল, ইমিটেশন
প্রবাল, ফিরোজা, ক্যাটস আই, ব্ল্যাক ক্যাটস আই, ব্রাউন ক্যাটস আই, হোয়াইট ক্যাটস আই, মুক্তা, মুনস্টোন, টাইগার, গার্নেড, ওপেল, আকিক, সোলেমানী আকিক, হাকিক, জমরুদ, মরিয়ম, গোমেদ, সেলুনী গোমেদ ও গয়া গোমেদ। পাথরের মধ্যে ডায়মন্ড বা বেলজিয়ামী ডায়মন্ডের ক্যারেট প্রতি বাজার মূল্য সময় ভেদে প্রায় ২ লক্ষ টাকা। সিলেটের বাজারে এই ডায়মন্ডের অস্থিত্বও নেই। এই ডায়মন্ডের স্থলে বিক্রি হচ্ছে এডি বা আমেরিকান ডায়মন্ড। যা সম্পূর্ণ কাচঁ দিয়ে ক্সতরি করা হয়। পান্না জাতের পাথরের মধ্যে ভাল পান্না হচ্ছে ছোঁয়াত পান্না। বাজারে এই পান্না পাওয়া না গেলেও কৃত্রিম ভাবে ক্যামিকেল দিয়ে ছোয়াত পান্নায় সিলেটের বাজার সয়লাব। ছোঁয়াত পান্নার প্রতি ক্যারেটের বাজার মূল্য হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। আসল রুবী বা চুনি পাথর পাওয়া না গেলেও বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে আছে বার্মিজ রুবী। যা বাজারে ক্যারেট প্রতি বিক্রি হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার টাকা দরে। নীলা নামের যে পাথরের সাথে মানুষের সবচেয়ে বেশি পরিচিতি তা বাজারে না থাকলেও এর বিকল্প হিসেবে বিক্রি হচ্ছে এ্যামিতিশ নীলা। নীলার ক্যারেট প্রতি বাজার মূল্য হচ্ছে প্রায় ১০ হাজার টাকা। পোখরাজ পাথরের নামে
বাজারে বিক্রি হচ্ছে টুপাজ। পোখরাজের ক্যারেট প্রতি বাজার মূল্য হচ্ছে প্রায় ৮ হাজার টাকা। প্রতি ক্যারেট রক্ত প্রবালের বাজার মূল্য প্রায় ৫ হাজার
টাকা হলেও বিভিন্ন ধাতবে ক্সতরি ইমিটেশন প্রবালের আধিক্যই বেশি। নিশাপুরী ফিরোজার বাজার মূল্য ক্যারেট প্রতি ৩ হাজার টাকা। ক্যাটস আই ৫ হাজার টাকা। মুক্তার প্রতি ক্যারেটের বাজার মূল্য প্রায় ৫ হাজার টাকা। সুনামগঞ্জের জাউয়ার প্রসিদ্ধ মুক্তাই আসল মুক্তা হলেও এখন আর এই মুক্তা
পাওয়া যায় না। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ ভারতে কৃত্রিমভাবে চাষ করা মুক্তা বাজারে বিক্রি হচ্ছে। যা সামুদ্রিক মুক্তা হিসেবে পরিচিত। আসল মুনস্টোন এখন আর পাওয়া যায় না। ঘোলাটে রঙের আসল মুনস্টোন পাওয়া না গেলেও বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ঝলমলে নকল মুনস্টোন। যার বাজার মূল্য ক্যারেট প্রতি ১ হাজার টাকা। টাইগার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকা ক্যারেট দরে। গোমেদ পাথরের মতো দেখতে গার্নেডের বাজার মূল্য ১ হাজার টাকা।
ওপেলের ক্যারেট প্রতি বাজার মূল্য ৩ হাজার টাকা। সোলেমানী আকিকের অস্থিত্ব না থাকলেও সিঙ্গেল পাথর কেটে তৈরি করা আকিক নামের ‘হাকিক’ পাথর বিক্রি হচ্ছে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পিস হিসেবে। পান্নার মতো দেখতে জমরুদ পাথরের ক্যারেট প্রতি বাজারমূল্য ৩ হাজার টাকা। কাঠের টুকরোর মতো দেখতে মরিয়ম পাথরের ক্যারেট প্রতি বাজার মূল্য ৫ শত টাকা।
স্থানীয় বিভিন্ন পাথর কোয়ারী থেকে সংগ্রহকৃত ও ভারত থেকে চোরাইপথে আসা নকল পাথরে সিলেটের বাজার সয়লাব। কুঁড়িয়ে আনা সিঙ্গেল
পাথর মেশিনে কেটে বিশেষ ক্যামিকেল দিয়ে গ্লাসে ঘষে পাথরকে উজ্জ্বল করে তোলা হয়। আর শুধুমাত্র অজ্ঞতার কারণেই প্রতারিত হন ক্রেতারা। এই প্রতারণার শেষ কোথায়? এ প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি সংশ্লিষ্ট পাথর ব্যবসায়ীদের অনেকেই।
এদিকে ‘অষ্টরত্ন’র নিয়ন্ত্রণে থাকা সিলেটের জুয়েলারী পাড়ায় বইছে বিতর্কের ঝড়। ভারতীয় আইসি গোল্ড আর এ্যালুমোনিয়ামের রৌপ্য অলংকার’ নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে দ্বিধা বিভক্ত জুয়েলারী ব্যবসায়ীরা দফায় দফায় ক্সবঠকে মিলিত হলেও পরস্পরকে দোষারোপ করা ছাড়া আর কোন ইতিবাচক ফলাফল বেরিয়ে আসছেনা। এমতাবস্থায় অধিকাংশ জুয়েলারী ব্যবসায়ীর কাছে সাধারণ ক্রেতাগণ প্রতারণার শিকার হচ্ছেন।