সিলেটে ঢুকছে 'লুটের পাথরবাহী' ট্রাক
ডিসির আদেশ লঙ্ঘন
শাহ আরেফিন টিলা ক্ষতবিক্ষত, অভিযান নেই খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো চিঠি দিয়েছে জেলা প্রশাসকে
বিশেষ প্রতিবেদক:: প্রতি রাতে শত-শত পাথরবাহী ট্রাক সিলেটের এয়ারপোর্ট রোডে প্রবেশ করছে। এসব ট্রাক সিলেট হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাচ্ছে। ট্রাকে বোঝাই করা হচ্ছে সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্র ও শাহ আরেফিন টিলার লুটের পাথর। এলসির আড়ালে অবৈধভাবে উত্তোলন করা পাথর সিলেট থেকে পাচার করা হচ্ছে। অথচ, অবৈধভাবে পাথর উত্তোলন, সংরক্ষণ ও পরিবহনে সিলেটের জেলা প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। কিন্তু পাথরখেকো সিন্ডিকেট জেলা প্রশাসনের সরকারি আদেশ লঙ্ঘন করে পাথর নিয়ে যাচ্ছে। ডিসি সারওয়ার আলম অন্যকাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় তাঁর বিভাগগুলো আদেশটি বাস্তবায়নে নজরদারি করছে না।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেলো, পাথরগুলো লুট হওয়া কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর ও শাহ আরেফিন টিলার। এলসির নামে এসব এলাকার লুটের পাথর কৌশলে সিলেটে নিয়ে আসা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের জারিকৃত আদেশ বাস্তবায়নে
ডিসির আদেশ লঙ্ঘন
শাহ আরেফিন টিলা ক্ষতবিক্ষত, অভিযান নেই খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো চিঠি দিয়েছে জেলা প্রশাসনকে
পাথরগুলোর বৈধতা যাচাই করা হচ্ছে না। গেল বছর ৫ আগস্টের পর সিলেটের পাথরকোয়ারিগুলো থেকে লুট করে নেওয়া হয় হাজার কোটি টাকার পাথর। এমনকি পর্যটন কেন্দ্র সাদাপাথরও লুট করে নেয় পাথরখেকোরা। একইভাবে লুটে নেওয়া হচ্ছে শাহ আরেফিন টিলার পাথর। জব্দ করা লুটের পাথর দিয়ে সাদাপাথরের কিছুটা প্রাণ ফিরিয়ে আনা গেলেও
শাহ আরেফিন টিলার অবস্থা একেবারে ক্ষতবিক্ষত। পুরো শাহ আরেফিন টিলা যেন পরিণত হয়েছে মরা কঙ্কালে। কোম্পানিগঞ্জের ওসি ও ইউএনও শাহ আরেফিন টিলার পাথর লুটে সম্পৃক্ত বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো লুট বন্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসককে চিঠি দিয়েছে। কিন্তু ডিসির স্থানীয় প্রশাসন শাহ আরেফিন টিলার লুট থামাতে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
জেলা প্রশাসনের কার্যালয় জানায়, গত ২৬ আগস্ট সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম স্বাক্ষরিত এক আদেশে 'অবৈধভাবে বালু ও পাথর উত্তোলন, সংরক্ষণ ও পরিবহনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। তার এই নির্দেশের পর কিছুদিন বালু পাথর পরিবহন ও সংরক্ষণ অনেকটা বন্ধ ছিল। গত কয়েকদিন ধরে নতুন করে সিলেটে বেড়েছে লুট হওয়া পাথর পরিবহন।পাথরলুটকাণ্ডের পর পুকুরে, মাটির নীচে, কচুরিপানা দিয়ে ঢেকে রাখা হয় এসব পাথর। কোন কোন >
সিলেটে ঢুকছে 'লুটের
এলাকায় ধানিজমিতে ফেলে রাখা হয় পাথর। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেটরা র্যাব-পুলিশের যৌথ অভিযান চালিয়ে এসব পাথর উদ্ধার করেন।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, এখনও লুটের পাথর বিভিন্ন এলাকায় লুকিয়ে রাখা আছে। সুযোগ বুঝে এসব পাথর ট্রাক বা ট্রাক্টর দিয়ে পরিবহন করা হচ্ছে। পাথর তুলে সিলেটে পাঠাতে 'ম্যানেজ পার্টি' রেডি রাখা হয়েছে। ধরা পড়লে এলসির পাথর দেখিয়ে ছাড়িয়ে নেওয়ার কাজ করছে 'ম্যানেজ পার্টি'।
কোম্পানিগঞ্জ ও জাফলং পাথর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সাদা পাথর লুট বন্ধে ডিসি সারওয়ার আলম যেভাবে তৎপর ছিলেন, বর্তমানে ডিসির বিভাগগুলো সেই আদেশ বাস্তবায়নে নিয়মিত নজরদারি রাখছে না। এ সুযোগে আবারও লুটেরা চক্র সক্রিয় হয়েছে। একমাত্র জাফলং থেকে এলসির ভাঙা পাথর বোঝাই ট্রাক সিলেটে প্রবেশের সময় সেনা তল্লাশি ও নজরদারির আওতায় পড়ছে। এর ফলে জাফলং এলাকার লুটের পাথর সিলেট হয়ে বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। হরিপুরে সেনাবাহিনীর স্থায়ী চেক পোস্ট থাকায় এই রুটে চোরাচালান পণ্যও কম প্রবেশ করছে। অথচ কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর পর্যটন কেন্দ্রের লুট হওয়া পাথর এখনো পুরোপুরি উদ্ধার করতে পারেনি প্রশাসন। শুরুর দিকে র্যাব-৯ ও জেলা প্রশাসন যেভাবে সক্রিয় ছিল এখন সেটি আর হচ্ছে না। পাথর উদ্ধার অভিযান বন্ধ আছে। পাথর ভাঙার কলে যতটুকু এলসির পাথর ভাঙা হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি আসছে লুটের পাথর।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, গত ২৬ আগস্ট সরকারি আদেশ জারি করে পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন, সংরক্ষণ ও পরিবহন নিষিদ্ধ করেছিলেন; সেটি নানা কারণে বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এরমধ্যে রয়েছে- ডিসি অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়া, সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো তার আদেশ পালনে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করা; ডিসি, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের মধ্যে সমন্বয় এবং যোগাযোগের অভাব। এছাড়া প্রয়োজনীয় জনবল ও অন্যান্য সংস্থার পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবে আদেশ বাস্তবায়ন হচ্ছে না।
এদিকে, সিলেটে যোগদানের পর ডিসির অন্যান্য অগ্রাধিকার কাজে নজর দিতে গিয়ে পাথর লুটে নজরদারি রাখতে পারছেন না। আবার বালু মহালের বৈধ ইজারার বালু ও বৈধ এলসির পাথর পরিবহন বিষয়েও আইনি বা পদ্ধতিগত জটিলতা তৈরি হয়েছে। যে কারণে পাথর ও বালু লুট বন্ধে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম-এর আদেশ বাস্তবায়নে নজরদারির অভাব দেখা দিয়েছে।
কোম্পানীগঞ্জের একটি সূত্র জানায়, কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথরের লুটের পাথর এতদিন গোপনে লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। প্রশাসনের নজরদারি কমে যাওয়ায় আবার মিল মালিকরা এলসির আড়ালে লুটের পাথর ভাঙা শুরু করেছেন।
অন্যদিকে, পুলিশ ও ইউএনওর নীরব ভূমিকায় শাহ আরেফিন টিলায় ব্যাপকভাবে পাথর লুট হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহ আরেফিন টিলার পাথর লুটে জড়িত আছেন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা উপজেলা আওয়ামী লীগের ধর্ম সম্পাদক হুশিয়ার মিয়া ও যুবদল নেতা বাবুল মিয়া। এই দুজনের লোকেরা প্রতিদিন শাহ আরেফিন টিলা থেকে কোটি কোটি টাকার পাথর লুট করছে। যা স্থানী-য়ভাবে সংরক্ষণ ও পরিবহন হচ্ছে। কয়েকদিন আগে শাহ আরেফিন টিলার পাথর চুরি করে নিয়ে যাওয়ার সময় ট্রাক্টর চাপায় এক পর্যটক নিহত হন। তারপরও বন্ধ হচ্ছে না পাথর চুরি।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে বাবুল মিয়া ও হুশিয়ার মিয়ার মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তাদের দুজনেরই মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
এ বিষয়ে জাফলং স্টোন ক্রাশার মিল মালিক ও ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইলিয়াস উদ্দিন লিপু বলেন, 'পাথর অবৈধভাবে উত্তোলন, সংরক্ষণ ও পরিবহনের ক্ষেত্রে ডিসির জারিকৃত আদেশ আমাদের জানামতে এখনও বলবৎ আছে। জাফলংয়ে খুব কম পরিমাণ এলসির পাথর বোঝাই ট্রাক সিলেটের দিকে যাচ্ছে। হরিপুরে সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট থাকায় জাফলং থেকে কোনো অবৈধ পাথর যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যেগুলো যাচ্ছে তা পরিমাণে খুব কম, কিন্তু এলসির পাথর যাচ্ছে। বেশিরভাগ পাথর বোঝাই ট্রাক কোম্পানীগঞ্জ থেকে সিলেটে প্রবেশ করছে। এসব ট্রাক আমাদের জাফলংয়ের নয়।'
জানতে চাইলে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাঈদা পারভীন বলেন,' আমরা হকার উচ্ছেদ, রেলস্টেশনের টিকিট অনিয়ম-এসব বিষয় নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। কোম্পানীগঞ্জের লুটের পাথর পরিবহনের বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে আলাপ করবো। আশাকরি, ডিসি মহোদয় এ বিষয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণে নির্দেশ দেবেন।'
এ বিষয়ে খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো (বিএমডি)-এর মহাপরিচালক (যুগ্ম-সচিব) মো. আনোয়ারুল হাবীব বলেন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার শাহ আরেফিন টিলায় অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনের খবর আমরা পেয়েছি। এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে গত ২ নভেম্বর আমরা সিলেটের জেলা প্রশাসনকে চিঠি দিয়েছি। খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরোর আওতাধীন শাহ আরেফিন টিলার পাথর উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
সূত্র দৈনিক নিরপেক্ষ
প্রকাশক ও সম্পাদক : মোঃ নিজাম উদ্দিন, নির্বাহী সম্পাদক : আইয়ুব আলী অফিস ; খান কমপ্লেক্স, সোনারপাড়া, শিবগঞ্জ, সিলেট। যোগাযোগ : প্রকাশক ও সম্পাদক : ০১৭৩৭-৩০৪৭৫১। ই-মেইল : sylhetbuletin@gmail.com
All rights reserved © 2025 sylhet buletin