সেলিম মাহবুব,ছাতকঃ
দেশের আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতি বিভিন্ন কারণে সংকটে পড়েছে। এসবের অবস্থানগত যে দ্যোতনা রয়েছে, সেটি ভুলে গেলে চলবে না। তাই বাংলা ভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে আঞ্চলিক ভাষা ও সংস্কৃতি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। সুনামগঞ্জে ‘হাওর এলাকার ভাষা ও সংস্কৃতির বৈচিত্র অন্বেষণ’ শীর্ষক কর্মশালায় আলোচকরা এই মত প্রকাশ করেছেন।
জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে শনিবার ১৬ আগষ্ট আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনিস্টিটিউটের উদ্যোেগে এ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আসাদুজ্জামানের সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন, সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া। স্বাগত বক্তব্য দেন ইনিস্টিটিউটের অতিরিক্ত পরিচালক আবুল কালাম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ইনস্টিটিউটের উপ-পরিচালক খিলফাত জাহান যুবাইরাহ।
কর্মশালায় সুনামগঞ্জের লোকসংস্কৃতির অনুসন্ধান’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনযুর উল হায়দার সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের বিয়ের গান ও ধামাইল নাচে নারীর জীবন’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক রোখসানা পারভীন চৌধুরী। লেখক ও সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদী উপস্থাপন করেন, হাওরজনের কথা, ভাষা ও আশা’ শীর্ষক প্রবন্ধ।
মুক্ত আলোচনায় বক্তব্য দেন কবি ও লেখক ইকবাল কাগজী সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি ও দৈনিক সুনামগঞ্জের খবর’ পত্রিকার সম্পাদক পঙ্কজ কান্তি দে, লেখক সুবাস উদ্দিন, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জগৎজ্যোতি পাবলিক লাইব্রেরির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খলিল রহমান, লেখক ও গবেষক এনামুল কবির, শিক্ষক কানিজ সুলতানা, আজিজুর রহমান ও অনূপ নারায়ণ তালুকদার, সাংবাদিক পীর মাহবুবুর রহমান, সাংবাদিক ও সংস্কৃতিকর্মী দেওয়ান গিয়াস চৌধুরী প্রমুখ।
মুক্ত আলোচনায় বক্তারা বলেন, হাওর এলাকার ভাষা এবং সংস্কৃতির যে ঐতিহ্য রয়েছে সেটি ধরে রাখতে উদ্যোগে নিতে হবে। এগুলো যেন হারিয়ে না যায়। নতুন প্রজন্মের সঙ্গে এই ভাষা ও সংস্কৃতির পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। এতে শেকড়ের সন্ধান মিলবে।
আউল, বাউলের চারণভূমি সুনামগঞ্জ তাঁর ঐতিহ্যের ধারা থেকে আজো বিচ্যুত হয়নি উল্লেখ করে বক্তারা আরো বলেন, ঐতিহাসিক ভাবেই সুনামগঞ্জ আলাদা ভাষা এবং আলাদা সংস্কৃতি ধারণ ও লালন করে আসছে।
ভাষা নিয়ত পরিবর্তনশীল এবং ভাষার পরিবর্তন হয় এলাকা ভিত্তিক দূরত্বের উপর নির্ভর করে। সে হিসেবে সুনামগঞ্জের মানুষের মুখের ভাষা প্রকৃত বাংলা ভাষা হতে বেশ খানিকটা দূরে। এখানে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকের বসবাস যার ফলে ভাষারক্ষেত্রেও রয়েছে বৈচিত্র্য। পুঁথিপাঠ, বাউল গান, জারি—সারি, ভাটিয়ালি, ধামাইল, কীর্তন, গাজীর গীত, লোকশিল্পের মধ্যে নকশি কাঁথা, নকশি শিখা, হাতপাখা, বাঁশ ও বেতের কাজ, মাটির নকশা, পাটশিল্পে সুনামগঞ্জের আলাদা বৈশিষ্ট আছে। পল্লী ও লোক সংস্কৃতিতে আমরা পাই মাঝির ভরাট গলার গান, রাখালের বাঁশির সুর। এছাড়া অসংখ্য আউল, বাউল, পীর, ফকির, দরবেশ, বৈষ্ণব, সন্ন্যাসীদের অসংখ্য সৃষ্টিশীল গান যা মানুষকে পরমেশ্বরের সন্ধান পেতে সাহায্য করে।
এগুলোও আমাদের এক মূল্যবান রত্নভাণ্ডার। বার মাসে তের পার্বণে ভরপুর হিন্দুদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের পাশাপাশি তাদের রয়েছে বিভিন্ন বর্ত, মেলা ও উৎসব। মুসলিম সম্প্রদায়ের রয়েছে গাজির গীত, মুহররমের গান, মর্সিয়া, কাওয়ালী ইত্যাদি। এছাড়া এখানকার লাঠি খেলা ও নৌকা দৌড় এককালে খুবই জনপ্রিয় ছিল। আজো এর রেশ শেষ হয়ে যায় নি। থিয়েটার, নাটক, যাত্রা ও কবি গানের লড়াই তো আছেই। এক কথায় জারি সারি ভাটিয়ালীর দেশ আমাদের এই সুনামগঞ্জ।
বক্তারা বলেন, আসাম রাজ্যের অন্তর্গত থাকায় সিলেটের ভাষা ও সংস্কৃতিতে আসামের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। যা জগন্নাথপুর, ছাতক, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার স্থানীয় জনগণ নিজেদের মধ্যে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলেন। অন্যান্য উপজেলায় বিভিন্ন অঞ্চল যেমন সিলেট অঞ্চল, ময়মনসিংহ অঞ্চল, কুমিল্লা অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা হয়।