পরিবহন মালিক নেতা লোকমান আহমদ (বাঁয়ে) ও শ্রমিক নেতা ময়নুল হক (ডানে)।
নিজস্ব প্রতিবেদক
সিলেটে পাঁচ দফা দাবি আদায়ে মঙ্গলবার থেকে পরিবহন শ্রমিকদের কর্মবিরতির ঘোষণা রোববারই দেওয়া হয়েছিলো।
ওই দিন সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন বাস-মিনিবাস, কোচ-মাইক্রেবাস, ট্রাক, পিকআপ, কাভার্ডভ্যান, সিএনজি, ইমা-লেগুনা ও পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ’ প্রশাসনের উর্ধনত কর্মকর্তাদের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে মঙ্গলবার থেকে সর্বাত্মক পরিবহন ধর্মঘট শুরুর কথা বলা হয়।
তবে এতে বিপত্তি বাধান সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি ও জামায়াত নেতা লোকমান আহমদ। তিনি রোববার রাতে মালিক সমিতির এক সভা শেষে জানান, আহুত শ্রমিক কর্মবিরতি ও ধর্মঘটে তারা অংশ নেবেন না। বরং তাদের মালিকানাধীন যানবাহন সড়কে চলাচল করবে।
এরপর সোমবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলন করে সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন বাস মিনিবাস মালিক সমিতি এবং সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন বাস-মিনিবাস, কোচ-মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়ন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, মঙ্গলবার থেকে যথারীতি পরিবহন শ্রমিকদের কর্মবিরতি শুরু হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই কর্মসূচী চলবে। কর্মবিরতির ফলে মঙ্গলবার থেকে সিলেটে গণপরিবহনসহ কোন যানবাহন চলবে না বলে জানানো হয়।
এসময় বলা হয়, কর্মবিরতি প্রত্যাখান করা লোকমান আহমদ পরিবহন মালিক সমিতির কেউ নয়। তার কোন গাড়ি নেই। এছাড়া আগের পাঁচ দফা দাবির সঙ্গে নতুন করে সিলেটের জেলা প্রশাসককে প্রত্যাহারের দাবিও যুক্ত করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে পরিবহন শ্রমিক ও মালিক নেতারা তাদের কর্মসূচীতে সবপক্ষের সমর্থন রয়েছে জানালেও লোকমান আহমদের বক্তব্যকে ঘিরে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে বিভ্রন্তি সৃষ্টি হয়েছে। আদৌ গাড়ি চলবে নাকি ধর্মঘট চলবে এ নিয়ে বিভ্রান্তিতে তারা।
আন্দোলনকারীদের ৬ দফা দাবির মধ্যে রয়েছে- সড়ক পরিবহণ আইন ২০১৮ এর ৩৬ ধারা প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সরকার বাস-মিনিবাসের ক্ষেত্রে ২০ বছর এবং ট্রাক পিকআপ কাভার্ডভ্যান ২৫ বছর, সিএনজি ও ইমা লেগুনা এর ক্ষেত্রে ১৫ বছর ইকোনোমিক লাইফ নির্ধারণ করার প্রজ্ঞপন বাতিল করতে হবে। সিলেটের সকল পাথর কোয়ারীর ইজারা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার ও সনাতন পদ্ধতিতে বালু মহাল এবং পাথর কোয়ারী খুলে দিতে হবে। বিআরটিএ কর্তৃক সকল গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট প্রদানে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র বাতিল ও গণ পরিবহন ও পণ্য পরিবহনের উপর আরোপিত বার্ধিত টেক্স প্রত্যাহার করতে হবে। সিলেটের সকল ক্রাশার মিলের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করন বন্ধ, বিদ্যুৎ মিটার ফেরত ও ভাংচুরকৃত মিলের ক্ষতি পূরণ এবং গাড়ি থেকে নিয়ে যাওয়া পাথর ও বালুর ক্ষতি পূরণ দিতে হবে। সড়কে বালু ও পাথরবাহী গাড়িসহ সকল ধরনের পণ্যবাহী গাড়ির চালকদের হয়রানী বন্ধ করতে হবে এবং সিলেটের পরিবহন মালিক-শ্রমিক ও ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া সিলেটের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে অবিলম্বে সিলেট থেকে প্রত্যাহার করতে হবে।
সোমবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন বাস-মিনিবাস, কোচ-মাইক্রোবাস শ্রমিক ইউনিয়নের ময়নুল হক বলেন, লোকমান আহমদ কে? তাকে আমরা চিনি না। তার কোন গাড়ি নেই। তিনি বাস মালিক সমিতির নেতাও হন। তিনি আমাদের কর্মসূচীর সাথে আছেন কি নাই, তাতে কিছু আসে যায় না। আমরা দাবি আদায়ে কর্মসূচী চালিয়ে যাবো।
লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, সিলেটের গণপরিবহণ-পণ্যপরিবহণ ও পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী মালিক শ্রমিকরা ফ্যাসিস্ট সরকারের আমল থেকেই বিভিন্নভাবে বঞ্চিত অবহেলিত। আওয়ামী সরকারের মদদপুষ্ট একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের রোষানলে পড়ে সিলেটের কোটি মানুষের নেমে আসে অবর্ননীয় দুর্ভোগ। ২০১৮ সালে বন্ধ করে দেওয়া হয় সিলেটের সব পাথর কোয়ারি। বর্তমানে লাখ লাখ কর্মহীন মানুষের কারণে সিলেটে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে এ অঞ্চলে। অন্যদিকে রিজার্ভের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে বিদেশ থেকে পাথর আমদানি করা হচ্ছে। তারা পাথর কোয়ারি খোলে দেওয়ার দাবিতে বারবার আন্দোলন সংগ্রাম করে ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কিন্তু ৫ আগস্টের পরেও তারা জুলুম নির্যাতন ষড়যন্ত্র থেকে রেহাই পাননি।
তিনি জানান, সড়ক পরিবহণ আইন ২০১৮ এর ৩৬ ধারায় যে প্রজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে, তা মালিম শ্রমিককে ধ্বংসের নীল নকশা। একইভাবে গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট বেসরকারি প্রতিষ্টানকে দেওয়া আরেক হয়রানী ও ষড়যন্ত্র। তাছাড়া গাড়ি তল্লাশির নামের পুলিশ ট্রাক শ্রমিকদের প্রতিনিয়ত হয়রানী করছে।
এসব কারণে সিলেট জেলা সড়ক পরিবহণ বাস-মিনিবাস, কোচ-মাইক্রোবাস, ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ডভ্যান, সিএনজি, ইমা-লেগুনা ও পাথর সংশ্লিষ্ট মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ ৬ দফা দাবিতে মঙ্গলবার (৮ জুলাই) সকাল ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সিলেট জেলাজুড়ে পরিবহণ কর্মবিরতি (ধর্মঘট) আহ্বান করেছেন।
তিনি জানান, আমরা পুলিশ কমিশনার, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতি ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ শ্রমিক ফেডারেশনকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।
এদিকে, সিলেটের ট্রাক-লরি মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের ডাকে পুরো জেলায় শনিবার থেকে ৭২ ঘন্টার পণ্য পরিবহন ধর্মঘট চলছে। যা আজ শেষ হবে।
এরআগে রবিবার রাত সাড়ে ১০টায় দক্ষিণ সুরমা বাস টার্মিনালে সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির জরুরী সভা শেষে লোকমান আহমদ লোকমান আহমদ দাবি করেন, চলমান কর্মবিরতি ও ধর্মঘট প্রকৃতপক্ষে মালিক ও শ্রমিকদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে আহ্বান করা হয়নি। বরং এটিকে ব্যক্তি স্বার্থে ব্যবহার করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, যারা শ্রমিকদের ব্যবহার করে পাথর কোয়ারির আন্দোলন করছেন, তারা পরিকল্পিতভাবে শ্রমিকদের প্রশাসনের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছেন। এটি সুস্পষ্টভাবে একটি দুরভিসন্ধিমূলক অপচেষ্টা।
সম্প্রতি এই পাঁ দফা দাবির সাথে একমত পোষণ করে তাদের আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করেন সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আরিফুল হক চৌধুরী।
অপরদিকে, ধর্মঘট প্রত্যাখানের ঘোষণা দেওয়া জেলা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি লোকমান আহমদ দক্ষিণ সুরমা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও জামায়াত নেতা। ফলে, এই ধর্মঘট ঘোষণা ও প্র্রত্যাখানকে বিএনপি জামায়াত নেতাদের মধ্যে দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ বলেও দেখছেন অনেকে।