শরীয়তপুর প্রতিনিধি:
পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা রক্ষার মূল বাঁধে নতুন করে আকস্মিক ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে ঝুঁকিতে পড়েছে পদ্মা সেতু দক্ষিন প্রান্তের পূর্বনাওডোবা ইউনিয়নের জিরো পয়েন্ট এর মাঝি কান্দি এলাকার পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা রক্ষার মূল বাঁধ।
সোমবার(৭ জুলাই) বেলা ৩টার দিকে রক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়। আকস্মিক ভাঙ্গনে ওই এলাকার ছাত্তার মাদবর কান্দির অন্তত ৩০০ মিটারের মতো অংশ নদীতে ধসে পড়ে। ভাঙনে রব শেখ, জিয়াউর রহমান ফকির সুজন ফকির, জাহাঙ্গীর ফকিরসহ অন্তত ১৫ জনের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং আবুল বাসার মাদবর, খলিল মাদবর, স্বপন মাদবর, রাজা মাদবর ও দেলা মাদবরসহ অন্তত ৮ জনের বাড়ি ঘর বিলীন হয়ে যায়। এরা কেউ তাদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিতে পারেনি। এদিকে ভাঙন আতঙ্কে অন্তত ৩০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বসতঘর সরিয়ে নিয়েছে স্থানীয়রা।
এর আগে গত বছরের নভেম্বর এবং গত জুন মাসে ২ দফায় রক্ষাবাঁধের ৩০০ মিটার অংশ ভেঙে যায়। স্থানীয়দের অভিযোগ পানি উন্নয়ন বোর্ডের অবহেলায় ও দ্রুত বাঁধ মেরামতে পদক্ষেপ না নেওয়াও এমন ভয়াবহ ভাঙ্গনের শিকার হলো এলাকাবাসী।
পানি উন্নয়ন বোর্ড(পাউবো) ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত বছরের নভেম্বর মাসে ওই এলাকায় পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা রক্ষা বাঁধের প্রায় ১০০ মিটার অংশ নদীতে বিলীন হয়। তখন শরীয়তপুর পাউবো তাৎক্ষণিকভাবে মেরামত কাজ শুরু করতে পারেনি। চার মাস সময় ক্ষেপণ করে চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল থেকে ২ কোটি ৮৯ লাখ ৮৭ হাজার টাকা ব্যয়ে বালুভর্তি জিওব্যাগ ও সিসি ব্লক ফেলে মেরামত কাজ শুরু করে। ওই সময় বাঁধ মেরামত প্রকল্প পরিদর্শন করতে আসলে, ভাঙনের বিষয়টি জানার পরেও দ্রুত কাজ শুরু না হওয়ার কারণ জানতে চাইলে, তখন এ বিষয়ে কোনো উত্তর দিতে পারেননি শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তারেক হাসান।
এর পর এ বছরের ৭ জুন পুনারায় উজান এবং ভাটি মিলিয়ে আরও অন্তত ২০০ মিটার বাঁধ ভেঙে যায়। ওই সময় ভাঙনের কারনে ৩ জনের বসতবাড়ি ও ২টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়া হয়।
শরীয়তপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী তারেক হাসান জানান, "প্রায় এক যুগ আগে সেতু বিভাগ পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা রক্ষার জন্য এই বাঁধ নির্মাণ করেছিল। গতবছরের নভেম্বর মাসে জাজিরার পূর্বনাওডোবা জিরোপয়েন্ট এলাকায় ১০০ মিটার অংশ ভেঙে পড়ায় পাউবো ও বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ (বিবিএ) যৌথভাবে সমীক্ষা চালায়। তাতে দেখা গেছে, প্রায় ১ কিলোমিটার অংশে বাঁধের নিকটে নদীর গভীরতা বেড়েছে এবং তলদেশ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। বাকি ১ কিলোমিটার অংশেও নদী বাঁধের কাছাকাছি চলে এসেছে এবং মাটির ক্ষয় অব্যাহত রয়েছে। ফলে পুরো বাঁধ এখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।"
তিনি আরও জানান, সোমবার উজান এবং ভাটি মিলিয়ে আনুমানিক ২০০ মিটার বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। এই মুহূর্তে ভাঙ্গন কমাতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। জিও ব্যাগ প্রস্তুত করা হয়েছে। রাতের মধ্যেই সেগুলো ডাম্পিং করা হবে। বাঁধ মজবুতকরণের জন্য একটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট প্রপোজাল (ডিপিপি) প্রস্তুত করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে আগামী বর্ষার আগে পুরোপুরি ভাবে বাঁধ মেরামতের কাজ সম্ভব হবে না।
এলাকাবাসীর অভিযোগ গতবছরের নভেম্বরে বাঁধ ভেঙ্গে গেলে পাউবো শরিয়তপুর সঠিক সময়ে, বাঁধ মেরামত শুরু করতে পারেনি যার জন্য এখন ভাঙন শুরু হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তারেক হাসান বলেন, বর্তমান ভেঙে যাওয়া অংশের সাথে পূর্বে ভেঙে যাওয়ার কোন সম্পর্ক নেই। পূর্বের ভেঙ্গে যাওয়া মেরামতকৃত অংশ অক্ষত রয়েছে। মূলত পাশাপাশি জায়গায় নতুন করে ভেঙেছে। কারন আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে বাঁধ মেরামতের যে ধরনের কাজ করেছি তাতে আমরা প্রশংসার দাবিদার। তাছাড়া এই প্রকল্প এলাকার বাঁধ নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ।
জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা(ইউএনও) কাবেরি রায় আমাদের মাতৃভূমিকে বলেন, আজকের ভাঙ্গনে ৯ ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান ও ১০ টি বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে। উৎসুক জনতার কারণে ভুক্তভোগীরা তাদের বাড়িঘর সরিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছেন। এজন্ আমরা সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চেয়েছি। আর ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য শুকনো খাবার ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হবে।
বাড়িঘর হারানো স্বপন মাদবর আমাদের মাতৃভূমিকে বলেন, হঠাৎ করে পানিতে কিছু একটা ভেঙে পড়া শব্দ পাই। গিয়ে দেখি কয়েকটি দোকান ভেঙে নদীতে চলে গেছে। এরপরে ঘরের আসবাব পত্র সব সরিয়ে ফেলি। তার আধা ঘন্টার মধ্যেই পদ্মা আমার বাড়িঘর সব কেড়ে নিল। নিঃস্ব হয়ে গেলাম। মাথা গোজার ঠাঁই টুকুও থাকলো না। গত বছর যখন এখানকার বাঁধ ভেঙ্গে গেল তখন যদি, সাথে সাথে বাঁধটি মেরামত করা হতো, তাহলে হয়তো আজ আমাদের বাড়িঘর হারাতে হতো না।
ভাঙ্গনের শিকার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের মালিক, জিয়াউর রহমান আমাদের মাতৃভূমিকে বলেন, দুপুরে বাড়িতে খাবার খেতে গিয়েছিলাম। হঠাৎ শুনি, পদ্মা সব ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে। দোকানে এসে দেখি নদীর ভেতরে আমার দোকানটি পড়ে আছে। সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম। সর্বনাশা পদ্মা নদী প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়ারও সময় দিল না। এখন পরিবার নিয়ে কিভাবে চলব বুঝতে পারছি না।
উল্লেখ্য, পদ্মা সেতুর এলাকায় বালুচর গড়ে ওঠা এবং বাঁধের নিকটবর্তী স্থানে নদীর গভীরতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এমন তীব্র ভাঙন শুরু হয়েছে। বর্ষায় পানি বাড়ার সাথে সাথে ভাঙনের তীব্রতাও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এছাড়া, ভাঙনকবলিত এলাকার আশেপাশের অন্যান্য স্থানও ঝুঁকিতে রয়েছে। এ অবস্থায়, পদ্মা সেতু প্রকল্প এলাকা রক্ষায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা পাঠিয়েছে পাউবো। মন্ত্রণালয় থেকে প্রকল্প অনুমোদন পেলেই এই বর্ষা শেষে শুষ্ক মৌসুমে মূলবাঁধ রক্ষা কাজ শুরু করা হবে।
বাঁধটি মজবুত করা না হলে, পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের ৫০০ মিটারের মধ্যে থাকা সার্ভিস এরিয়া-২, সেনানিবাস, পদ্মা সেতু দক্ষিণ থানা, একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নাওডোবা-পালেরচর সড়ক, মঙ্গল মাঝি ও সাত্তার মাদবর বাজারসহ।
প্রকাশক ও সম্পাদক : মোঃ নিজাম উদ্দিন, নির্বাহী সম্পাদক : আইয়ুব আলী অফিস ; খান কমপ্লেক্স, সোনারপাড়া, শিবগঞ্জ, সিলেট। যোগাযোগ : প্রকাশক ও সম্পাদক : ০১৭৩৭-৩০৪৭৫১। ই-মেইল : sylhetbuletin@gmail.com
All rights reserved © 2025 sylhet buletin