শিরোনাম
৩২ কেজি গাঁজাসহ মাদক ব্যবসায়ী আটক ১ সুনামগঞ্জ এর ছাতকে শালি ধর্ষণের শিকার  তারেক রহমান যুব পরিষদ জামালপুর জেলা শাখার নবগঠিত কমিটির সংবর্ধনা।  শেরপুর পুলিশ লাইন্সে পবিত্র মাহে রমজান উপলক্ষে ইফতার ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত কানাইঘাটে বেপরোয়া গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ গেল কলেজ শিক্ষার্থীর! ফেনীতে দাবিকৃত ঘুষ না পেয়ে হয়রানি করার অভিযোগ ৩ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নবীগঞ্জ কল্যাণ সমিতি সিলেটের ইফতার ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত অব্যাহত ধর্ষণ, খুন, নৈরাজ্য প্রমাণ করে দেশ চালাতে ব্যর্থ হচ্ছে সরকার: সিপিবি ঢাবি’র প্রাক্তন ভিসি আরেফিন সিদ্দিক মা-বাবার পাশেই শায়িত হলেন  উখিয়ায় রোহিঙ্গার সঙ্গে ইফতারে প্রধান উপদেষ্টা ও জাতিসংঘ মহাসচিব
শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫, ০১:৫৮ অপরাহ্ন

সাফল্য অর্জনকারী সিলেটের ৫ জয়িতার গল্প !

স্টাফ রিপোর্টার / ৩৯ Time View
Update : বুধবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক :

বিভিন্ন ক্যাটাগরীতে সাফল্য অর্জনকারী সিলেট জেলার শ্রেষ্ঠ পাঁচজন জয়িতাকে সম্মাননা প্রদান করেছে জেলা প্রশাসন ও মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সিলেট।

আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় তৃণমূলের সংগ্রামী নারীদের উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছর জীবনযুদ্ধে জয়ী নারীদের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ শীর্ষক কার্যক্রমের ধরাবাহিকতায় সিলেটে জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত ৫ জন শ্রেষ্ঠ জয়িতা-২০২৪ এর সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠান গত ৯ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মোঃ রেজা-উন-নবী ও সভাপতি সিলেটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ জেলা পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ ৫ জয়িতা অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী সিলেট নগরীর আম্বিয়া খাতুন, শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী কানাইঘাট উপজেলার হালিমা বেগম, সফল জননী ওসমানীনগর উপজেলার নূরজাহান বেগম, নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে নতুন জীবন শুরু করেছেন যে নারী বিয়ানীবাজার উপজেলার ডেজি আক্তার পপি, সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী নগরীর বালুচরের শেখ রওশন আরা নিপা-কে সম্মাননা ও পুরস্কার প্রদান করেন।

অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী ক্যাগরীতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা আম্বিয়া খাতুন ১৯৮৫ সালে সিলেট নগরীর এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ৯ ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। নবম শ্রেণির ছাত্রী থাকাকালীন তার বিয়ে হয় নগরীর চারাদিঘিরপাড়, ৪-আলআমানী এর বাসিন্দা আসাদ আলীর সাথে, যিনি ছিলেন একজন মুদির দোকানী। আম্বিয়া বেগমের স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। সে জন্য তিনি সেলাইয়ের কাজ, ব্লকবাটিক, বুটিক ও এমব্রয়ডরির কাজ শিখে ছিলেন। কিন্তু বিয়ে তার স্বপ্ন ভেঙ্গে দেয়। যৌথ পরিবারে বড় বউ তিনি, পরিবারের বড় ছেলে হওয়াতে সংসারের সকল দায়িত্ব ছিল তার স্বামীর উপর। সে দায়িত্ব পালন করতে করতে একসময় তিনি ক্লান্ত হয়ে পরেছিলেন। শত ক্লান্তি যেন তাদের ভালোবাসায় ফাটল না ধরাতে পারে সেই দিকে ছিল আম্বিয়া খাতুনের সকল প্রচেষ্টা।

২০০১ সালে তিনি যখন প্রথম সন্তান সম্ভবা হন তখন তার স্বামীর ব্যবসা ভালো চলছিল না। সংসারের অন্ন জোগাড় করা তার পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছিল। আম্বিয়া বেগম স্বমীর পাশে দাঁড়াতে গিয়ে তার এক আত্মীয়ের কাছ থেকে একটি সেলাই মেশিন ধার আনেন, শর্তে ছিল বিনিময়ে তিনি যখন যা কাজ করে দিতে বলবেন তা করে দিতে হবে এবং যখন মেশিন ফেরত চাইবেন তখন ফেরত দিতে হবে। আম্বিয়া খাতুন সকল শর্ত মেনে মেশিনটি আনলেন। সেলাই কাজ করে কিছু টাকা উপার্জন করতে লাগলেন, তা দিয়ে তার স্বামীর সাথে নিজেও সংসারের হাল ধরা শুরু করলেন। কিন্তু ৫/৬ মাস যেতে না যেতেই তার আত্মীয় সেলাই মেশিনটি ফেরত নিয়ে যান। আম্বিয়া খাতুন কী করবেন ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছিলেন না। তিনি মেশিনটি পাওয়ার পর একটি দোকানের কারিগরি মজুরীতে সেলাই কাজ করতেন। কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অবশেষে তিনি দোকানীকে বিষয়টি জানালে তিনি তাকে ৫ হাজার টাকা ধার দেয়। ঐ টাকা দিয়ে আম্বিয়া খাতুন একটি সেলাই মেশিন ক্রয় করে পূণরায় কাজ শুরু করেন।

সেলইয়ের আয় থেকে ধার করা ৫ হাজার টাকা পরিশোধ করার পর কিছু সঞ্চয়ও করা শুরু করেছিলেন। তার সঞ্চয়, স্বামীর দোকানের আয় এবং নিজের বিয়ের স্বর্ণের গহনা প্রায় ৮০ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিয়ে নিজ বাসায় বুটিকের কাজ শুরু করেন। ঢাকা থেকে সস্তায় কাপড় এনে নিজে কাজ করতেন। বুটিকের কাজ তার অনেকের পছন্দ ছিল। পরবর্তীতে তিনি এর পাশাপাশি আরশি বুটিক হাউজে রেখেও কাপড় বিক্রি করতেন। বিক্রি হলে তারা তার টাকা দিয়ে দিত। এইভাবে তার বুটিক ও সেলাইয়ের কাজ এক সাথে চলতে থাকে। বুটিকের বিক্রি ভাল হওয়ায় আড়শি বুটিকে হাউজের প্রোপ্রাইটার নিজে জামিনদার হয়ে পূবালী ব্যাংক থেকে ২০ লাখ টাকা লোন নিয়ে দেন। সেই টাকা দিয়ে তিনি ২০০৫ সালে নগরীর জেল রোডে একটি ছোট দোকান দেন। সেই থেকে তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরবর্তীতে আরেকটি সেলাইয়ের দোকান নেন, যা এখনো বর্তমানে আছে। বর্তমানে তার ১টি সেলাই কারখানা রয়েছে যেখানে ২০টি সেলাই মেশিন রয়েছে, মাস্টার টেইলারসহ মোট ২২জন কর্মচারী তার প্রতিষ্ঠানে কাজ কারছেন। জেল রোডস্থ জিহা ফ্যাশন এন্ড টেইলার্স নামে ১টি বুটিকের দোকান রয়েছে যেখানে ৮ জন কর্মচারী কাজ করেছে।

আম্বিয়া খাতুন কঠোর পরিশ্রম করে অর্থনৈতিক ভাবে সফল হয়ে সমাজে উদাহরণ সৃষ্টি করায় তাকে অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী শ্রেষ্ঠ জয়িতা।

শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে কৃতিত্ব অর্জনকারী নারী ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা হালিমা বেগম ১৯৭১ সালের ২০ মার্চ কানাইঘাট উপজেলার অন্তর্গত দর্পনগর পূর্ব গ্রাম জন্মগ্রহণ করেন। তার ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। মেয়ে সন্তান্ত হওয়ার কারণে শত বাঁধা বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে হালিমা বেগম এস.এস.সি পরীক্ষায় ১ম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ভাল রেজাল্ট করায় উচ্চ শিক্ষার জন্য ভালো কলেজে ভর্তি হতে মন:স্থির করেন। তৎকালীন সময়ে কানাইঘাট উপজেলায় সরকারী/বেসরকারী কোন ধরনের কলেজ ছিলোনা। তাই তিনি সিলেট সরকারি মহিলা কলেজে ভর্তি হন। ২য় বিভাগে এইচ.এস.সি পাশ করেন এবং সিলেট এম.সি কলেজে গণিতে নিয়ে অনার্সে ভর্তি হন। এমসি কলেজে অধ্যয়নরত অবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নিয়ে ১৯৯৯ সালে চাকুরীতে যোগদান করেন। অনার্স পড়া তার না হলেও পরবর্তীতে তিনি প্রাইভেটে সফলতার সাথে বিএসএস, এমএসএস পাস করেন। তিনি বি-এড, সি-ইন-এড, সম্পন্ন করেন। তখন কানাইঘাট উপজেলায় কোন মহিলা প্রধান শিক্ষক ছিল না। তার প্রমোশনের সুযোগ আসলে তিনি প্রধান শিক্ষক হওয়ার জন্য আবেদন করেন।

কানাইঘাট উপজেলার ১ম মহিলা প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন রায়গড় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু সেখানে শিক্ষার কোনো পরিবেশই ছিল না। ক্লাসে ছাত্রছাত্রী খুব কমই উপস্থিত হত। অভিভাবকদের চিঠি দিয়ে, পায়ে হেটে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থী সংগ্রহ করেন। এতে অভিভাবকদের বেশ সাড়া পান এবং শিক্ষার একটি পরিবেশ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে এ বিদ্যালয়টি ‘ডি’ ক্যাটাগরী থেকে ‘এ’ ক্যাটাগরীতে উন্নিত হয়। এ ঘটনা নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার কথা মনে করিয়ে দেয়।

হালিমা বেগম উপজেলা পর্যায়ে ১০ বার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। বর্তমানে তিনি বায়মপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দক্ষতা ও সফলতার সাথে কর্মরত আছেন। তার বিদ্যালয়টি উপজেলা পর্যায়ে ২০২২ ও ২০২৪ সালে শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে নির্বাচিত হয়। তিনি কানাইঘাট উপজেলার বিভিন্ন কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বলে উপজেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে সকলেই তাকে এক নামে চিনে।

হালিমা বেগম পল্লী গ্রামে মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তখনকার সময়ে সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে থেমে না গিয়ে সমাজে উদাহরণ সৃষ্টি করায় আজ তিনি শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী শ্রেষ্ঠ নারী জয়িতা।

সফল জননীর কৃতিত্ব অর্জনকারী নারী ক্যাটাগরীতে শ্রেষ্ঠ জয়িতা নূরজাহান বেগম ১৯৬৭ সালে সিলেট জেলার ওসমানীনগর উপজেলার সাদিপূর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। চার বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। ১৯৭২ সালে তার পাঁচ বছর বয়সে ঘাতকব্যধি ক্যান্সারে তার বাবা মারা যান। বাবা মারা যাওয়ার পর তার মা ও বোনেরা নকশি কাঁথা সেলাই, শীলত পাটি তৈরি, দর্জির কাজ, টিউশনি, যখন যা সুযোগ পেতেন করতেন। এভাবে অতি কষ্টের মধ্য দিয়ে চলছিল তার লেখাপড়া। তিনি যখন এসএসসি পরীক্ষার্থী তখন পরীক্ষার ফিস দেওয়ার জন্য তার খুব শখের একটা শীতল পাটি তাকে বিক্রি করতে হয়েছিল। তিনি ১৯৮৪ সালে ৫৫০ নম্বর পেয়ে ২য় বিভাগে এসএসসি পাশ করেন।

নূরজাহান বেগম ১৯৮৬ সালের ৩০ নভেম্বর সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করে তৃতীয় স্থান অধিকার করে তার নিজ বিদ্যালয়, বিয়ানীবাজার উপজেলার সারপার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকুরীতে যোগদান করেন। ১৯৯০ সালে পিটিআই প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করে তিনি কোর্স সমাপনীতে ১ম স্থান অধিকার করেন। প্রশিক্ষণ চলাকালীন সময়ে ১৯৯০ সালে ১৬ই মার্চ তার বিয়ে হয়। ঘরে ছিলেন দুই ভাসুর ও দুই ননদ। বড় ভাসুর লন্ডন প্রবাসী, তিনি তার স্ত্রীকে খুবই পর্দায় রাখতেন বিধায় নূরজাহান চাকুরী করেন এটা উনি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি। তিনি পরিবারের ভ্রাতৃত্ব টিকিয়ে রাখতে চাকুরী ছাড়ার অভিনয় করেন, গোপনে দরখাস্তের মাধ্যমে ছুটি নিয়ে চাকুরী বহাল রাখেন। দীর্ঘদিন এভাবে চলতে থাকে, এর ফাঁকে নূরজাহান বেগমের স্বামী সৌদিআরব চলে যান। সেখানে প্রায় আড়াই বছর থাকার পর সম্পূর্ণ খালি হাতে রোগী হয়ে বাড়ি ফিরেন। ঠিক ঐ সময় ১৯৯৬ সালে ফেব্রুয়ারী মাসে জেলা শিক্ষা অফিস, সিলেট থেকে তার নামে কারণ দর্শানো নোটিশ আসে। আর তখনই ঐ শোকজের উত্তরে বড় ভাসুরের অনুমতি নিয়ে তিনি পুনরায় বিদ্যালয়ে যোগদান করেন এবং অদ্যাবধি সফলতার সাথে শিক্ষকতা করে আসছেন।

নূরজাহান বেগম ১৯৯৬ থেকে শিক্ষা অফিসে প্রায় ৫ বছর দৌড়ঝাপ করার পর অফিসারগণ তার পাঠদানের যোগ্যতা ও দক্ষতা বিবেচনায় ২০০০ সনের ২৬শে জুন ৮৬৫ দিনের বিনা বেতনে অসাধারণ ছুটি মঞ্জুর করেন। তার আন্তরিক প্রচেষ্টা ও পাঠদান কৌশল বিদ্যালয়ের চেহারা পাল্টে দিয়েছে। সি ক্যাটাগরীর বিদ্যালয়কে তিনি এ ক্যাটাগরীতে উন্নীত করেন। ২০০৬ সনের ৫ এপ্রিল তিনি পদোন্নতি পেয়ে প্রধান শিক্ষক হিসেবে আদমপুর সরকারী প্রথমিক বিদ্যালয় যোগদান করেন। তার অক্লান্ত পরিশ্রমে ও আন্তরিক প্রচেষ্টায় এখানেও বৃত্তি আসছে, পাসের হার ১০০%। এ নিয়ে তিনি গর্বিত।

চাকুরী ক্ষেত্রে সফল হলেও পারিবারিক শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি তার। নিজ বেতনের টাকা নিজে ভোগ করতে পারতেন না। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৮ সাল পযন্ত ১৯ বছর তিনি শুধু বেতনের টাকার চেক স্বাক্ষরের মালিক ছিলেন, টাকার মুখ দেখেননি। তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি সেলাই’র কাজ ও টিউশনি করতেন। এগুলো করে যা উপার্জন করতেন তা দিয়ে ২ ছেলে ও ২ মেয়ের লেখাপড়াসহ জামাকাপড়ের ব্যয় নির্বাহ করতেন। তিনি তার স্বামীকে ২টি দোকানের ব্যবস্থা করে দিয়েও সফল হননি, নিজ বেতন থেকেও প্রতিমাসে ৫ হাজার টাকা স্বামীকে দিতে হত। মুখ বুজে সব সহ্য করতেন কেবলমাত্র সন্তানদের মানুষের মতো মানুষ করার আশায়। তার স্বামী ঘরের খরচ পর্যন্ত দিতেন না। তার নিঃসন্তান বড় ভাসুরকে কোন সন্তানাদি না থাকায় নিজের বড় ছেলেকে উনাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তার ২য় মেয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পরও তিনি এবং তার ননদ মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ করার জন্য খুব চেষ্টা করেছিলেন। সকলের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনি মেয়েকে শাবি’তে ভর্তি করান। এত মানসিক নির্যাতন সহ্য করার পরও শক্ত হাতে হাল ধরেছিলেন তিনি। তার মেয়ে মাস্টার্স সমাপ্ত করেছে। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক হয়েছে। ২০০৬ সালের তিনি প্রথান শিক্ষক হিসেবে পদোন্নতি পান। লেখাপড়া শিখিয়ে ছেলেমেয়েদের প্রতিষ্ঠিত করতে তার অবদান সবচেয়ে বেশী।

তার বড় ছেলে লিডিং ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ পাশ করে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে ২০২১ সাল থেকে কর্মরত আছেন।

২য় মেয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসএস পাশ করে ওসমানীনগর উপজেলার কিয়ামপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হন। ২০২২ সালে ঢাকায় বিয়ে দেওয়ার পর শিক্ষকতা ছেড়ে ঢাকা বারডমে হসপিটালে বর্তমানে কর্মরত আছেন। ৩য় ছেলে নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ পাস করে ইউ.সি.বি এল ব্যাংকে কর্মরত আছেন। পাশাপাশি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাবল মাস্টার্স করছেন। চতুর্থ এবং সবার ছোট মেয়ে বর্তমানে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে ফাইনাল সেমিস্টারে আছেন। তিনি নিজেও সন্তানদের সাথে তাল মিলিয়ে ২০১৯ সালে উনন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএস পাস করেন।

জীবন সংগ্রাম শেষে তিনি একজন সফল মা হতে পেরেছেন। স্বামী সহযোগিতা ছাড়াই জীবনের সব শখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করায় নূরজাহান বেগম সফল জননী শ্রেষ্ঠ নারী জয়িতা।

নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে নতুন জীবন শুরু করেছেন যে নারী বিয়ানীবাজারের ডেজি আক্তার পপি। তিনি বিয়ানীবাজার উপজেলার অন্তর্গত কাকরদিয়া তেরাদল গ্রামে দরিদ্র পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিলনা। পরিবারের একমাত্র উপর্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন তার বড় ভাই। বড় ভাই সি.এন.জি অটো রিকশা চালিয়ে যে টাকা উপার্জন করতেন তা দিয়ে সংসার চলত। দারিদ্রতার কারণে তিনি ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। ২০০৯ সালের ২৮ এপ্রিল বেকার যুবের আহমদের সাথে ডেজি আক্তার পপি’র বিবাহ হয়। বিবাহের পর থেকে শ্বাশুড়ি, খালা শ্বাশুড়ির ও দেবরের নানা রকম অত্যাচার শুরু করে। সব কিছু সহ্য করে তিনি সংসার করতে থাকেন। বিবাহের তিন বছর পর পপি ১টি পুত্র সন্তানের জননী হন। তার স্বামীকে ব্যবসা করার জন্য পিত্রালয় হতে টাকা এনে দেন। যেন স্বামীর বেকারত্ব মোচন হয়। কিন্তু তার স্বামী সেই টাকাগুলো আড্ডা ও জুয়া খেলে নষ্ট করে।

তার বড় ভাই জীবিকার সন্ধানে চট্টগ্রামে গিয়ে গাড়ী চালাতেন। তিনি বড় ভাই এর কাছ থেকে টাকা এনে সন্তানের খরচ ও স্বামীর খরচ চালাতেন। বড় ভাই এর কাছে কান্নাকাটি করে তার স্বামীকে চট্টগ্রামে নিয়ে যেতে। বড় ভাই বোনের কথামতো তার স্বামীকে চট্টগ্রামে নিয়ে যান ও একটি গাড়ীতে ড্রাইভিং কাজের ব্যবস্থা করে দেন। কয়েকদিন গাড়ী চালানোর পর তার স্বামী নেশা শুরু করেন, এমনকি গাড়ীতে মাতাল হয়ে পড়ে থাকতেন। মাতাল অবস্থায় তার বড় ভাই বাসায় নিয়ে আসতেন ও ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলতেন। কিছুদিন পর তার স্বামী বাড়ী চলে আসেন, এর জন্য শ্বাশুড়ি ও দেবরের কাছ থেকে নানা কথা শুনতে হত।

ডেজি আক্তার পপি তার মা কে বলেন, এভাবে আর চলতে পারছেন না, একটি উপায় বের করে দেওয়ার জন্য। এক পর্যায়ে জানতে পারেন বিয়ানীবাজার হাসপাতালের উপরে একটি ক্যান্টিন করার জন্য স্থান আছে, তিনি সেখানে ক্যান্টিন দেওয়ার জন্য মন:স্থির করেন। নিকটবর্তী একটি ব্যাংক হতে ঋণ নিয়ে তিন লক্ষ টাকার চুক্তির মাধ্যমে জায়গাটি বরাদ্দ পান। অতঃপর আবার ব্যাংক হতে এক লক্ষ টাকা ঋণ উত্তোলন করে তার স্বামীকে দেন কেন্টিন চালাতে। ঋণের সকল দায়ভার তার ও তার মায়ের উপর থাকে। কিছু আয় রোজগার বাড়তে থাকলে তার স্বামী মেয়েদের সাথে আমোদ ফূর্তিতে জড়িয়ে পড়ে। তিনি স্বামীকে বুঝিয়েও কন্ট্রোল করতে পারেননি। ঠিকমতো ব্যাংকের কিস্তি চালাতে না পারায় স্বামীর সাথে ঝগড়া হয় এবং তার স্বামী তাকে মারধরও করেন। তিনি অন্য একটি ব্যাংক হতে এক লক্ষ টাকা ঋণ নিয়ে সেই টাকা দিয়ে বাকি কিস্তিগুলো চালাতে থাকেন। তখন তার ছেলের বয়স ৫ বছর। এর কিছিুদিন পর একটি কন্যা সন্তান জন্ম গ্রহণ করে। কন্যার বয়স যখন ৯ মাস তখন তার ভাইয়ের কাছ থেকে টাকা এনে স্বামীকে বিদেশ পাঠান। বিদেশ যাবার পর ঋণের টাকা পরিশোধ করা তো দূরের কথা তাদের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেয় তার স্বামী। সে আবার মেয়েদের সাথে আমোদ ফূর্তিতে জড়িয়ে পড়ে বলে জানা যায়। কয়েক মাস পর তিনি সন্তানদের নিয়ে চট্টগ্রামে চলে যান বড় ভাইয়ের কাছে। ২০২২ সালে ১ জানুয়ারি পপি বিয়ানীবাজার ফিরে আসেন। বাড়ীতে ফিরে আসার ৬ মাস পর স্বামীর সাথে তালাক হয়।

ডেজি আক্তার পপি কাজের জন্য ইউনিয়ন পরিষদে যান, সেখানে শুনতে পান বিয়ানীবাজার উপজেলায় মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে বিউটিফিকেশন এর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এটা শুনে তিনি বিউটিফিকেশনের কোর্সে ভর্তি হন। বিউটিফিকেশনের ক্লাস করার জন্য তার আত্মীয়-স্বজন নানা রকম অপবাদ দেয়। এসব কথা কানে না নিয়ে তিনি তার লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। বিউটিফিকেশনের কাজের পাশাপাশি তিনি কেক তৈরীর কাজ আয়ত্ত করেন। কেক তৈরীর কাজ শিখে এখন তিনি অর্ডার অনুযায়ী কেক বিক্রি করেন। দেড় বছর পর তিনি সেলাই প্রশিক্ষণ নেন। আবারো প্রতিবেশীরা নানা বিরুপ মন্তব্য শুরু করে। এসব কথায় তিনি কর্ণপাত করেননি। তিনি তার লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। বর্তমানে তার সন্তান ও পরিবার নিয়ে সুখে শান্তিতে দিন যাপন করছেন। তিনি বিয়ানীবাজার উপজেলায় মামনি পার্লারে প্রথমে শেয়ারে ব্যবসায় ছিলেন বর্তমানে কর্মী হিসেবে ২৫ হাজার টাকা বেতনে কর্মরত। এর পাশাপাশি তিনি তার ইউনিয়নে আগ্রহী মহিলাদেরকে বিউটিফিকেশন ও সেলাই এর প্রশিক্ষণও দিয়ে থাকেন। অনেক মেয়েরা তার পার্লারের কাজ দেখে তারাও পার্লারে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সব কিছুর পিছনে ছিল তার মায়ের সাহস ও সাপোর্ট। তিনি চান তার মতো মেয়েরা নির্যাতিত হয়ে যেন ঘরে বসে না থাকে, নিজেরা যেন ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে।

সকল সমস্যাকে পিছনে ফেলে একা সামনে এগিয়ে যাওয়া শিখেছেন। সন্তানদের নিয়ে আনন্দে দিন কাটাচ্ছেন। ডেজি আক্তার পপি ভাবেন তিনি নারী, তিনি সাহসী, তিনি অপরাজিতা। তাই তিনি শ্রেষ্ঠ নারী জয়িতা।

সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী : শেখ রওশন আরা নীপা ১৯৭৪ সালে সিলেট জেলার সিলেট সদর উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার মা, বাবা লন্ডন প্রবাসী হওয়ায় তার জন্ম হয় লন্ডনে। তার বয়স যখন ১১/১২ তখন তিনি লন্ডন থেকে বাংলাদেশে আসেন এবং স্কুলে ভর্তি হন। স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন সমাজের উন্নয়নে কাজ করেছেন। তার টিফিনের টাকা থেকে অসহায় গরীব ছাত্র ছাত্রীদের নাস্তা কিনে দিয়েছেন। তিনি টিউশনি করে সেই টাকা দিয়ে গরিবদের সাহায্য করেছেন। তাছাড়া তার জমানো সঞ্চয়ের টাকা থেকে বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজ করেছেন। পরবর্তীতে তিনি লেখাপড়া শেষ করে প্রবাসী ছেলেকে বিয়ে করে লন্ডন চলে যান। লন্ডনে গিয়েও নীপা বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত হয়ে বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজে যোগ দেন এবং উন্নয়ন মূলক কাজের জন্য তিনি বিভিন্ন সংস্থা থেকে কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ বিভিন্ন এওয়ার্ড পেয়েছেন। তিনি লন্ডনে থাকলেও দেশের জন্য তার খুব টান ছিল।

শেখ রওশন আরা নীপা ইচ্ছা ছিল দেশের জন্য কিছু করবেন। তাই তার এলাকার অসহায় গরীব মানুষের কথা চিন্তা করে প্রায় ২২ বছর আগে ২০০০ সালে ২৩ ডিসেম্বর তার নিজ হাতে গড়ে তুলেন সিলেটের বালুচর এলাকায় তরুছায়া মহিলা সংস্থা নামে একটি সংগঠন। এই সংস্থাটি এখনো চলমান রয়েছে। এই সংস্থার মাধ্যমে তার নিজস্ব তহবিল থেকে বিভিন্ন উন্নয়ন মূলক কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি প্রতি বছরই বাংলাদেশে আসেন এবং সমাজের অবহেলিত নারী ও শিশুদের উন্নয়নে কাজ করেন।

শেখ রওশন আরা নীপা’র ব্যক্তিগত তহবিল থেকে নিঃস্বার্থভাবে সমাজের তথা দেশের উন্নয়নে যে সকল কাজ করছেন তাহলো ৩টি সেলাই প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, ১টি বয়স্কদের স্বাক্ষরতা কার্যক্রম ও ১টি ব্লক-বাটিক, নকশী কাঁথা, চটের ব্যাগ তৈরী এবং ক্রিস্টাল সোপিস তৈরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এর মাধ্যমে প্রায় ২০ হাজার অসহায় নারীদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রায় ৮ হাজার সেলাই মেশিন প্রদান ও ৩ শতজন নারী উদ্যোক্তা তৈরী করেছেন। ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য তাদেরকে ২০ হাজার টাকা করে অনুদান প্রদান করেছেন। প্রতিবন্ধি নারী পুরুষের মধ্যে প্রায় ৩ শত হুইল চেয়ার বিতরণ করেছেন নীপা। গরিব অসহায় মানুষদের চিকিৎসার জন্য প্রায় ১০ দশ লক্ষ টাকা বিতরণ ও ৬ শতজন বয়স্ক নারী পুরুষ কে স্বাক্ষর শিখানো হয়েছে। এই সকল উন্নয়ন কার্যক্রম শেখ রওশন আরা নীপা নিজস্ব অর্থায়নে জনস্বার্থে সম্পাদন করেছেন। তার এই কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে তিনি জানান।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ৩ সন্তানের জননী। সন্তানেরা সকলেই ইংল্যন্ড থাকেন। তিনি জানান তরুছায়া মহিলা সংস্থাটি সকলের সহযোগিতা পেলে দেশের উন্নয়নে কাজ করে যাবে।

উপরোক্ত কাজগুলোর মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ শেখ রওশন আরা নীপা শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা লাভ করেছেন।

মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর সিলেটের উপপরিচালক শাহিনা আক্তার বলেন, প্রতি বছরের ন্যায় এবছরও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়াধীন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে তৃণমূলের সংগ্রামী নারীদের উজ্জীবিত ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছর জীবনযুদ্ধে জয়ী নারীদের স্বীকৃতি প্রদানের জন্য জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ শীর্ষক কার্যক্রমের ধরাবাহিকতায় সিলেটে জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত ৫ জন শ্রেষ্ঠ জয়িতাকে সম্মাননা প্রদান করা হয়েছে। আগামীতেও মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে শ্রেষ্ঠ জয়িতা সম্মাননা প্রদান অব্যাহত থাকবে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ক্যাটাগরির আরো সংবাদ